02-21-2017, 08:32 AM
আজকেই লন্ডন চলে যাচ্ছে অনামিকা। আর কয়েক ঘন্টা পর
ফ্লাইট। যাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে উচ্চশিক্ষা। কিছুদিন
আগেই নামকরা ভার্সিটি থেকে বি এ কমপ্লিট করেছে ও। চলে
যাবার আগে গতকালকেই প্রায় সব বান্ধবীদের সাথে দেখা
করেছে ও।তাই আর কারো ওকে বিদায় জানাতে আসার কথা
নয়। একদম রেডি হয়েছে অনামিকা। এখনই বেড়িয়ে পড়বে, কে
জানে? যদি জ্যামে আটকা পড়ে? হঠাৎ করে ফোনটা বেজে
উঠল। ওর বেস্টফ্রেন্ড মীম কল করেছে। অনামিকা ফোন
ধরল।
- কোথায় তুই? বের হয়েছিস? (মীম)
- হ্যা, এখনি বের হব। (অনামিকা)
- আচ্ছা কিছুক্ষন ওয়েট কর, আমি আসছি তোর বাসায় একটা
জিনিস দিতে।
- কি,,,???
- গেলেই বুঝবি
- আচ্ছা তাড়াতাড়ি আয়।
- হুম, ১০ মিনিট লাগবে আর মাত্র।
.
ফোনটা রেখে ভাবতে বসে অনামিকা। কি এমন জিনিস হতে
পারে, যেটা ওকে এই শেষ সময়ে দেয়ার প্রয়োজন হল। গিফট
বা অন্যকিছু হলে তো মীম ফোনেই বলত। তাহলে কি
অন্যকিছু?? কি হতে পারে?
.
মীম এসেই তাড়াহুড়ো করে অনামিকার হাতে একটা প্যাকেট
দিলো। মনে হচ্ছে ডায়েরী আছে। অনামিকা জিজ্ঞেস করল,
"কি এতে আছে?? " মীম বলল, " একটা ডায়েরী, তোর পড়ার
দরকার, তাই দিতে এলাম। তবে পড়তে দেড়ি করিস না, অন্তত
ফ্লাইটে ওঠার আগে পড়ার চেষ্ঠা করিস। আমি গেলাম রে, কাজ
আছে। অনামিকা আবার ডাকল, ডায়েরীটা কার সেটাতো বলবি।
মীম উত্তর দিল, "অরন্যর ডায়েরী। " অনামিকা অবাক হল,
ওর মত আতেল ছেলের ডায়েরীতে কি আছে যা পড়তেই হবে।
আবার জিজ্ঞেস করল, ওর ডায়েরী তুই কোথায় পেলি ? মীম
বলল, ওর ব্যাগে আমার বই ছিল, ওটা বের করতে গিয়ে এটা
দেখি, অনিচ্ছা সত্তেও পড়েছি, ও জানেনা, তবে পড়ে ভুল
করিনি, তুই ও পড়িস । আচ্ছা বাই,,, " বলেই হাটা দিলো মীম।
অনামিকা এক মুহুর্ত হাতের প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে রইল।
তারপর ভাবল, এত করে যখন বলছে পড়ে দেখা উচিত। নিশ্চয়
কিছু আছে এতে। তবে লাগেজের ভিতর রাখার দরকার নেই।
যেহেতু মীম বলেছে ফ্লাইট ওঠার আগেই পড়তে, তাই হাতেই
নিল অনামিকা। বিমানবন্দর যেতে যেতে পড়া যাবে।
.
বিমানবন্দরে যেতে বেশীক্ষণ লাগার কথা নয়।তবে জ্যামে
পড়লে ভিন্ন কথা। অনামিকা ডায়েরীটা হাতে নিলো।ব্যাগ
থেকে চশমা বের করে পড়ল অনামিকা। কালো রঙ্গের চিকন
ফ্রেমের চশমা। আগে পড়ত না, কিছুদিন হল মাথা ব্যাথা করে,
তাই ডাক্তার চশমা পড়তে বলেছেন সবসময়। কিন্তু অনামিকা
মাঝে মাঝে খুলে রাখে। ডায়রীটার উপরে বিরাট করে A আঁকা।
প্রথম পাতায় শুধু নাম লিখা। অরন্য,,, অরন্যর নাম লেখা।
যেহেতু অরন্যর ডায়েরী সেহেতু ওর নাম লেখাটা স্বাভাবিক।
যাহোক পরের পৃষ্ঠা উল্টালো অনামিকা। এই পৃষ্ঠায় কয়েক
লাইনের ছড়া লেখা আছে,,,
.
তুমি মেঘ হলে আমি আকাশ
তুমি শিশির হলে আমি ঘাস
তুমি সাগর হলে আমি জল
তোমার ভিতরে আমার বসবাস
ছড়াটা তেমন ভাল লাগেনা অনামিকার। চট করে পাতা উল্টায়
ও। আর ভাবে কেনই বা মীম এত করে ওকে এটা পড়তে বলল।
তারপর অনেক পাতা খালি। অনেক কয়েকটা পাতার পরেই একটা
পাতায় একটা নুপুর সেলাই করার মত করে আটকানো। অনামিকা
অবাক হয়ে যায় কারণ নূপুরটা অনামিকার যেটা ভার্সিটিতে
হারিয়ে গিয়েছিল এক অনুষ্ঠানে। অনামিকা নূপুরটা খুলে নেয়।
হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর দ্রুত পেজ উল্টায়।
আবার একটা পেজে আটকে যায় ও। লাল রঙ দিয়ে অনামিকা
লিখে রাখা হয়েছে। এটা কি আসলেই রঙ?? না, রঙ নয়,, তার
মানে রক্ত দিয়ে লেখা!! অনামিকার কৌতুহল বাড়তে থাকে, ওর
জন্য কেন কেউ নিজের রক্ত দিয়ে নাম লেখবে? পেজ উল্টায়
ও। এবার লেখা পায়। অনামিকা মনযোগী হয়ে ডায়েরী পড়া শুরু
করে।
.
আমি ছেলেটা নাকি খুব বোকা। অন্তত সবাই তাই বলে।
কারো সাথে ঠিকমত কথা বলতে পারিনা। কার সাথে কখন কি
বলব বুঝে পাইনা। আর কয়েকদিন পরেই ভার্সিটির ক্লাস শুরু
হবে। বাসা থেকে অনেক দূরেই আমার ভার্সিটি। বলা যায় অন্য
শহরে। হলে সিট পাইনি। পাবই বা কি করে? আমার তো
বড়ভাই নেই। ভার্সিটির পাশে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি, আমি
আর বিপ্লব। বিপ্লবের বাসা আমাদের পাশের জেলায়। ভর্তির
দিনে পরিচয় হয়।তারপর দুজনে আলাপ করে বাসাটা ভাড়া নেই।
বিপ্লব ছেলেটা বন্ধু হিসেবে ভালই। আমার ওকে ভালই
লেগেছে। লম্বা, ফর্সা ছেলে, মুখে ছোট ছোট দাড়ি আছে।
তবে রাগ বেশী, কিন্তু সেটা ক্ষনিকের জন্য। ওর রাগ থাকে
২-১ মিনিট। তারপর আবার সব ঠিক, ওর এই ব্যাপারটা আমি
ইনজয় করি খুব, ওকে রাগিয়ে দেই, তারপর মজা নেই।
.
আজকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ১ম ক্লাস করলাম। বিপ্লব
আর আমি পাশাপাশি বসেছি, দুই বন্ধু তো। স্যার অনেক ভাল,
অত্যন্ত বিনয়ের সাথে কথা বলেন। স্যারকে খুব ভাল লেগেছে
আমার। তবে সব ছাপিয়ে গেছে একটা মেয়ে। নাম এখনো
জানিনা।
স্যার ১ম দিন উপলক্ষ্যে একটু সহজ অধ্যায় বুঝাচ্ছিলেন।
ক্লাসের কিছুসময় পার হয়ে গেছে। এমন সময় হঠাৎ করে সে
আসল।হ্যা, সেই মেয়েটা, যার কথা বললাম একটু আগে। চোখে
চশমা, চুল ছাড়ানো, ফর্সা সুন্দর দেখতে। দেরী করে এসেই ও
চিৎকার করল, মে আই কাম ইন স্যার? স্যার কিছুটা বিষন্ন
হয়েই তাকালেন ওর দিকে,, সাথে সাথে পুরো ক্লাস তাকালো
ওর দিকে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে একবার সব ছেলেগুলোর
দিকে তাকালাম। সব কয়টা ছেলেই মুখ হা করে ওকে দেখছে,
বিপ্লব ও। স্যার ওকে কিছুক্ষন রাগ দেখালেন, কারন ও ১ম
দিনেই দেরী করে এসেছে। পরে ও এসে আমার সামনের সিটে
বসল। ক্লাসের সব ছেলেই ওকে মাঝে মাঝে দেখছে,, আমিও।
বুঝে গেলাম যে আজ থেকে ও ক্লাসের ক্রাশ হতে চলেছে। তার
সাথে আরো বুঝলাম যে আমি এর পিছনে ঘুরলে ও টাইম পাব
না। কারণ আমি বোকা ছেলে। ওর চুলের থেকে শ্যাম্পুর ঘ্রাণ
আসছে, আমি মোহে পড়ে যাচ্ছি, শুধু আমি না, বিপ্লব ও।
বেয়াদবটার গার্লফ্রেন্ড আছে। তবু হা করে আছে। আমি
কলমটা ওর মুখে ঢুকিয়ে দিলাম। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বিপ্লব
তাকালো আমার দিকে, ওকে দাবড় দিলাম, তোর না জি এফ
আছে?? ও কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু চুপ করে গেল। আর আমি
শ্যাম্পুর ঘ্রাণে খাতায় একটা ছড়া লিখে ফেললাম। নিজেকে
কবি কবি লাগছে খুব, প্রেমের কবি। তবে অবশ্যই বোকা কবি।
ছড়াটা ছিল,
"পাগল করল কন্যা আমায় চুলের ঘ্রাণে,
তখন থেকে চেয়ে আছি আমি তার পানে
কবি কি তাকে করেছে বর্ণনা কবিতা কিংবা গানে?
ভালবেসেছি কিনা আমি জানিনা, এই মনটাই সব জানে"
.
ছিঃ! কি বিশ্রি লিখেছিস এটা?? বিপ্লব বলল। আমি লজ্জা
পেলাম। কত রোমান্স নিয়ে লিখেছিলাম আর ও বলল কিনা
বিশ্রী!! তার উপর আবার বলল, মেয়েটাকে দেখে লিখেছিস
বুঝি?? ভালো মামা! তবে টাইম পাবিনা রে!! আমি আশাহত
হয়ে ওর দিকে তাকালাম। বিপ্লব সব দাঁত বের করে আমার
দিকে তাকিয়ে জঘন্য একটা হাসি দিল। ইচ্ছে করল দুই হাত
দিয়ে ওর মুখটা চেপে ধরি, হাতটাও বাড়ালাম কিন্তু পারলাম না।
.
এখন আপাতত আমার কাজ কম। ভার্সিটি আসি পুরোটা ক্লাস
ওকে চুরি করে দেখি, ও অবশ্য টের পায়না। টের পেলে
চোখাচোখি হত। তারপর কথা, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর প্রেম।
কিন্তু আমি বোকা ছেলে, দূর থেকে দেখাই আমার কাজ, তাও
চুপি চুপি দেখা। বাসায় আর এখন মন টেকে না। সারাদিন
ক্যাম্পাসে আসতে ইচ্ছে করে। ও হলে থাকে। ওর হলের সামনে
গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। অবশ্য নামটা এখনো
জানিনা। আসলে কাউকে জিজ্ঞেস করিনি ওর নামটা। সেদিন
বিপ্লবকে কথার ছলে জিজ্ঞেস করেছি, ও সেটা পেচিয়ে আমার
নাতী, নাতনির নাম ঠিক করেছে! বুঝেন নি?? আচ্ছা শুনুন,
ওকে বললাম, বন্ধু, ভাই আমার, হেল্প করো।,, বিপ্লব বলল,
কি? আমি ওকে দেখিয়ে নাম জানতে চাইলাম। বিপ্লব এটা শুনে
২ পা পিছিয়ে শুরু করল প্যাচাল! ওরে মামা, এই ব্যাপার? অন্য
কারো নাম তো জানতে চাও না। তবে?? প্রেমে পড়েছ? এখন
নাম জানবে, কাল কথা হবে, তারপর বন্ধু, অতঃপর প্রেম!!
মাম্মা,, ভালোই প্ল্যান করেছিস। চাকরী পেলে বিয়ে করবি
তাইতো? তারপর বাচ্চা হবে, সে বড় হবে। তার বিয়ে দিবি
দুইজনে, আমি গিয়ে দাওয়াত খাব। বাপরে?? কয়েক বছর পর
আবার নাতি নাতনি হবে!! খাওয়া দে এখনি। আমি অবাক হয়ে
বললাম, কিসের খাওয়া, আর এত কি বলছিস?? বিপ্লব বলল,
ট্রিট হবে বন্ধু, প্রেমে পড়েছ, ট্রিট দিবা না? চলো চলো,,,,।।
তারপর তো আমার পকেট ফাকা হলো। কিন্তু নাম জানা
হলো না। বিপ্লবের এই রি একশন দেখে আর কাউকে জিজ্ঞেস
করিনি।
.
ভার্সিটির অনুষ্ঠান, আমি উপস্থাপনার দায়িত্বে আছি।
আমার সাথে আমাদেরই ব্যাচের একটা মেয়ে মীম আছে।
বিপ্লবের পর ওর সাথেই আমার ফ্রেন্ডশিপ হলো। তাও
অনুষ্ঠানের বদৌলতে। ও হ্যা, মেয়েটার নাম জানতে পেরেছি
আমি কয়েকদিন আগে। ওর নাম অনামিকা। নামের মতই সুন্দর
মেয়েটা। না না উপমাটা ঠিক হলো না,,, ওর নামটা ওর মতই
সুন্দর। মাঝে মাঝে ওর সামনে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, মেয়ে,
বোকা ছেলেটা যে তোমাকে দেখে সেকি জানো? চশমা খুলে
আয়নায় নিজেকে দেখেছো?? দেখোনি বোধহয়। আমি জানি
তোমায় চশমা ছাড়া একটু বেশী ভাল লাগবে। চশমায় কেমন
যেন বড় আপু ভাবটা আছে।,,, যাহোক অনুষ্ঠানে অনামিকা নীল
শাড়ি পড়ে এসেছে। আমি স্টেজের কোণ থেকে অনেক্ষণ ওর
দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলাম, শুধু আমি না, অনেকেই দেখছিল
ওকে,, তবে আমি একটু বেশীই দেখেছি হয়ত, ধরা পড়ে গেছি।
পরে মাথা নিচু করেছি, এই প্রথম ওর চোখে চোখ পড়েছে
আমার। আমি কিছুক্ষনের জন্য লজ্জা পেলেও মনে মনে খুব
খুশি হয়েছি,, তার উপর মীম এর সাথে অনামিকার বন্ধুত্ব ভাল।
এটা আমার জন্য ভাল দিক।
একটু আগে অনামিকার পায়ের একটা নূপুর হারিয়েছে। ঠিক
হারিয়েছে না, ওর পা থেকে খুলে গেছে, এখন পাওয়া যাচ্ছেনা।
সবাই খোজাখুজি করল অনেক্ষন। কিন্তু পেলো না। মীম
বলল, নূপুরজোড়া নাকি অনামিকার খুব পছন্দের। মেয়েটা নাকি
বড্ড কষ্ট পেয়েছে। এখন আমার কর্তব্য হলো, ওর সামনে
গিয়ে ম্যাজিশিয়ান এর মত করে নূপুরটা খুঁজে দেয়া।কিন্তু আমি
তার বিন্দুমাত্র করলাম না।কারণ আমি ম্যাজিশিয়ান নই। এবং
এর চেয়ে বড় ব্যাপার হলো নূপুরটা এখন আমার প্যান্টের বাম
পকেটে অবস্থান করছে। বাসায় গিয়ে নূপুরটা কোথাও রাখতে
হবে। বিশেষ স্থানে, যেখানে দেখলে মনে পড়বে যে নূপুরটা
আছে। অনুষ্ঠানের শুরুতে অনামিকার হাসিমুখ দেখেছি, তবে
এখন প্রিয় নূপুর এর শোকে ওর মুখটা কেমন বিষন্ন হয়ে
আছে। আর আমি স্বার্থপরের মত ওর নূপুর পকেটে নিয়ে
ঘুরছি।
আজকের দিনটা আমার কাছে স্মরনীয়। আজকে ১ম অনামিকার
চোখে আমার চোখ পড়েছে। এবং ওর একটা প্রিয় জিনিস
আমার কাছে আছে। নূপুরটা আমি ডায়েরীতে সুতা দিয়ে সেলাই
করার মত করে রেখেছি। আমি বোকা ছেলে, তাই কথা বলতেও
পারিনা ওর সাথে, এজন্য আর নূপুর ফেরত দিতেও গেলাম না।
বিপ্লব এসবের কিচ্ছু জানেনা। ও জানলে সমস্যা হবে তাই ওকে
বলিনি।
.
ভার্সিটি জীবনের এই বছরগুলো অনেক মজা করেই কাটলো।
তবে আজকের দিনটা নয়। অনামিকাকে একটা ছেলে প্রপোজ
করেছে, ও হেসেছিল কিছুক্ষণ, তারপর কিছু বলেনি। চলে গেছে
সেখান থেকে, মনে হয় হ্যা বলে দিবে। আমি তখন ব্রেঞ্চে বসে
কলম দিয়ে হাত ফুটো করে ফেলেছি, অনেকগুলো ফুটো হয়ে
গেছে,, বিপ্লব হঠাৎ করে আমার এই অবস্থা দেখে এসে হাত
চেপে ধরে, পরে পাশের ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে ব্যান্ডেজ করে
আনাল।আমি এখন বাসায় বসে ডায়েরীটাতে এসব লেখছি।
আবার হাত কাটতে ইচ্ছে করছে। পাশে একটা ব্লেড ছিলো।
হাতটা কাটলাম, রক্ত বের হচ্ছে, আমি পিশাচের মত করে
নিঃশব্দে হাসছি। ডায়েরীর একটা পাতায় লিখলাম আমার রক্ত
দিয়ে,,, অনামিকা। চোখ গুলো ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি কি
মরে যাচ্ছি?? রক্তক্ষরন বেশি হয়ে গেল? বিদায় তাহলে
পৃথীবিকে।
চোখ মেলে নিজেকে আবিস্কার করি হাসপাতালে। সেটা বড়
কথা নয়, বড় কথা হলো আমি যে অনামিকার প্রতি কতটা
দুর্বল সেটা বিপ্লব জেনে গেছে। এইত কিছুক্ষন আগেও সেটাই
বলে গেল। তার সাথে আরো বলে গেল যে অনামিকা কিছুদিন
বাদেই বিদেশে চলে যাবে। কথাটা শুনে বুকটা কেমন করে
উঠেছিল, অবশ্য অনার্স শেষ করে সবাই আলাদা হবে। তবুও
কেন যেন মনে হচ্ছিল আমি ওকে হারিয়ে ফেলছি। ইসস যদি
ওকে আটকাতে পেতাম। বিপ্লব এসে কানের কাছে একটা কথাই
বলেছিল, এত ভালবাসিস তো বললি না কেন বোকা? আর তো
পাবিনা ওকে।"
সামনের সপ্তাহেই অনামিকা চলে যাবে শুনলাম। এখন আমি
শারিরীক ভাবে সুস্থ। তবে মনের দিক দিয়ে অনেকটা অসুস্থ
আমি। সেটা আমি ছাড়া কেবলমাত্র বিপ্লব জানে। ও ইদানিং
আমাকে অনেককিছু করতে বলে, এইত সেদিন দুজনে রাতে
অনামিকার বাসার সামনে থেকে ঘুরে এলাম। ও বলল, চিৎকার
করতে, আমি করিনি। আমার মত বোকা ছেলেটাকে দিয়ে
আজকাল বিপ্লব অনেককিছু করাচ্ছে। আমি নিজেই অবাক হই
এসব করে করে। বিপ্লব আমাকে বুদ্ধি দিয়েছে অনামিকা যাবার
দিন যেন ওর বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে সব বলি। কিন্তু আমি
সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা করব না।ওকে কষ্ট দিব না আমি।
ডায়েরীতে আর কিছু লেখা নেই। চোখের কোণায় পানি আসার
মত হয়েছে। অনামিকা গাড়ির জানালাটা খুলে দিলো, হালকা
বাতাস আসছে। কেমন যেন ঘোর লাগছে নিজের ভিতর। আচ্ছা
অরন্য তো আতেঁল নামেই পরিচিত ছিল, তবে অরন্য পাশে
থাকলে মাঝে মাঝে মনে হত ও অনামিকার দিকে তাকিয়ে আছে,
কিন্তু সেরকম কখনোই অনামিকা ধরতে পারেনি।তাহলে???
ছেলেটা ওকে এতটা ভালবাসে?? ওর জন্য কি থাকা যায়না
এখানে?? কিন্তু ও কি জানে অনামিকা চলে যাচ্ছে,, ও কি
আসবে এয়ারপোর্ট এ? অনামিকা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়,অরন্য
একবার ওকে ডাকলেই ও আর বাইরে যাবেনা। দৌড়ে এসে
অরন্যকে জরিয়ে বলবে, এতটা ভালবাসো কেন? আর
ভালবাসলে বলতে পারোনা কেন? বোকা ছেলে???
গাড়ি এয়ারপোর্ট এ এসে গেছে। অনামিকা গাড়ি থেকে নেমে
চারপাশে তাকাচ্ছে, যদি অরন্য আসে,, অনেকক্ষন তাকিয়েও
লাভ হয়না। কারণ অরন্য আসেনি। অনামিকা আবারো মন
খারাপ করে।টিকিটের যাবতীয় কাজ শেষ করে অনামিকা
এয়ারপোর্ট এ ওয়েটিং রুমে বসে আছে। কোনো দিকেই ওর
ভাল লাগছে না।মন একদম খারাপ। ডায়েরীটা পরার পর থেকে
মনটা আনচান করছে।
অরন্য কি সত্য্যি আসবে না। উফ, অনামিকা নিজের উপর
নিজেই বিরক্ত হয়। এই ছেলেটাকে নিয়ে ওর কখনো কোন
চিন্তার উদ্রেক হয়নি। অথচ এখন ও অনামিকার মাথায় চেপে
বসেছে। অনামিকা বুঝতে পারেনা কি করবে। বাসায় চলে যেতে
ইচ্ছে করছে। আবার যে কারণে বাইরে যাচ্ছে, সেটা না করা কি
ঠিক হবে? এটা ভেবেও খারাপ লাগছে। টিভিতে গান চলছে,
ফালতু একটা গান। অনামিকা প্রচন্ড স্ট্রেসে মাথা চেপে ধরে
বসে থাকে। ওর কেন যেন মনে হয় ভুল করতে চলেছে ও, বিরাট
ভুল।
.
পাশের কেউ একটা নিউজ চ্যানেল দেয়। সাংবাদিকের কথা
শোনা যাচ্ছে, অনামিকা কান চেপে রাখলেও কথা গুলো শোনা
যাচ্ছে। অনামিকা বিরক্ত বোধ করে,, টিভির কথা গুলো ঠিক
এরকম,, " দেখুন দর্শক, পাগল প্রেমিকের কান্ড, প্রেমের টানে
মানুষ কত কি করে, তারই নমুনা দেখুন। ভালবাসার মানুষটাকে
দূরে যাওয়া হতে আটকানোর প্রচেষ্টারত প্রেমিক। পাশে থেকে
চিৎকার উঠে, "অনামিকা, আমি বিপ্লব, আমাকে তো চিনো।
অরন্য ছাগল টা তোমাকে ভালবাসে, আমরা এয়ারপোর্ট এর
বাইরে,, তুমি কোথায়....!! "
.
অনামিকা বসা থেকেই চট করে উঠে দাঁড়ায়। টিভিতে দেখে
অরন্য একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দারিয়েছে, তাতে লেখা Don't
leave me Anamika.I love u. অনামিকা অরন্যর কান্ড
দেখে হেসে ফেলে। তারপর এক দৌড়ে বাইরে চলে আসে।
বিপ্লব অনামিকাকে দেখেই অরন্যকে চিৎকার করে, ওই তো
এসে গেছে। অরন্য অনামিকার সামনে যায় আস্তে আস্তে।
অনামিকার কেমন যেন আনন্দ লাগে। এই বোকাসোকা ছেলেটা
ওর জন্য এত পাগলামি করতে পারে। ইসস, সবাই দেখছে,
অনামিকার লজ্জা লাগছে তবু দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। অরন্য
এখন একদম ওর সামনে। প্ল্যাকার্ড উচু করে ধরে আছে ।
অনামিকা জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবা?,,, অরন্য বলে, হু,,
অনামিকা আবার বলল, বলো। অরন্য উত্তর দেয়,, প্লিজ যেও
না। অনামিকা জিজ্ঞেস করে, আর কিছু। অরন্য মাথা নিচু
করে।হঠাৎ করে অরন্য একটা কাজ করে বসে,,অনামিকাকে
জড়িয়ে ধরে।অনামিকা প্রথমে বিব্রত বোধ করলেও সবার
হাততালি দেয়া দেখে সাহস পায়। চোখে পানি চলে আসে ওর,
এই বোকাটার পাগলামি দেখে। অনামিকাও জড়িয়ে ধরে
অরন্যকে পরম ভালোবাসায়।
ফ্লাইট। যাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে উচ্চশিক্ষা। কিছুদিন
আগেই নামকরা ভার্সিটি থেকে বি এ কমপ্লিট করেছে ও। চলে
যাবার আগে গতকালকেই প্রায় সব বান্ধবীদের সাথে দেখা
করেছে ও।তাই আর কারো ওকে বিদায় জানাতে আসার কথা
নয়। একদম রেডি হয়েছে অনামিকা। এখনই বেড়িয়ে পড়বে, কে
জানে? যদি জ্যামে আটকা পড়ে? হঠাৎ করে ফোনটা বেজে
উঠল। ওর বেস্টফ্রেন্ড মীম কল করেছে। অনামিকা ফোন
ধরল।
- কোথায় তুই? বের হয়েছিস? (মীম)
- হ্যা, এখনি বের হব। (অনামিকা)
- আচ্ছা কিছুক্ষন ওয়েট কর, আমি আসছি তোর বাসায় একটা
জিনিস দিতে।
- কি,,,???
- গেলেই বুঝবি
- আচ্ছা তাড়াতাড়ি আয়।
- হুম, ১০ মিনিট লাগবে আর মাত্র।
.
ফোনটা রেখে ভাবতে বসে অনামিকা। কি এমন জিনিস হতে
পারে, যেটা ওকে এই শেষ সময়ে দেয়ার প্রয়োজন হল। গিফট
বা অন্যকিছু হলে তো মীম ফোনেই বলত। তাহলে কি
অন্যকিছু?? কি হতে পারে?
.
মীম এসেই তাড়াহুড়ো করে অনামিকার হাতে একটা প্যাকেট
দিলো। মনে হচ্ছে ডায়েরী আছে। অনামিকা জিজ্ঞেস করল,
"কি এতে আছে?? " মীম বলল, " একটা ডায়েরী, তোর পড়ার
দরকার, তাই দিতে এলাম। তবে পড়তে দেড়ি করিস না, অন্তত
ফ্লাইটে ওঠার আগে পড়ার চেষ্ঠা করিস। আমি গেলাম রে, কাজ
আছে। অনামিকা আবার ডাকল, ডায়েরীটা কার সেটাতো বলবি।
মীম উত্তর দিল, "অরন্যর ডায়েরী। " অনামিকা অবাক হল,
ওর মত আতেল ছেলের ডায়েরীতে কি আছে যা পড়তেই হবে।
আবার জিজ্ঞেস করল, ওর ডায়েরী তুই কোথায় পেলি ? মীম
বলল, ওর ব্যাগে আমার বই ছিল, ওটা বের করতে গিয়ে এটা
দেখি, অনিচ্ছা সত্তেও পড়েছি, ও জানেনা, তবে পড়ে ভুল
করিনি, তুই ও পড়িস । আচ্ছা বাই,,, " বলেই হাটা দিলো মীম।
অনামিকা এক মুহুর্ত হাতের প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে রইল।
তারপর ভাবল, এত করে যখন বলছে পড়ে দেখা উচিত। নিশ্চয়
কিছু আছে এতে। তবে লাগেজের ভিতর রাখার দরকার নেই।
যেহেতু মীম বলেছে ফ্লাইট ওঠার আগেই পড়তে, তাই হাতেই
নিল অনামিকা। বিমানবন্দর যেতে যেতে পড়া যাবে।
.
বিমানবন্দরে যেতে বেশীক্ষণ লাগার কথা নয়।তবে জ্যামে
পড়লে ভিন্ন কথা। অনামিকা ডায়েরীটা হাতে নিলো।ব্যাগ
থেকে চশমা বের করে পড়ল অনামিকা। কালো রঙ্গের চিকন
ফ্রেমের চশমা। আগে পড়ত না, কিছুদিন হল মাথা ব্যাথা করে,
তাই ডাক্তার চশমা পড়তে বলেছেন সবসময়। কিন্তু অনামিকা
মাঝে মাঝে খুলে রাখে। ডায়রীটার উপরে বিরাট করে A আঁকা।
প্রথম পাতায় শুধু নাম লিখা। অরন্য,,, অরন্যর নাম লেখা।
যেহেতু অরন্যর ডায়েরী সেহেতু ওর নাম লেখাটা স্বাভাবিক।
যাহোক পরের পৃষ্ঠা উল্টালো অনামিকা। এই পৃষ্ঠায় কয়েক
লাইনের ছড়া লেখা আছে,,,
.
তুমি মেঘ হলে আমি আকাশ
তুমি শিশির হলে আমি ঘাস
তুমি সাগর হলে আমি জল
তোমার ভিতরে আমার বসবাস
ছড়াটা তেমন ভাল লাগেনা অনামিকার। চট করে পাতা উল্টায়
ও। আর ভাবে কেনই বা মীম এত করে ওকে এটা পড়তে বলল।
তারপর অনেক পাতা খালি। অনেক কয়েকটা পাতার পরেই একটা
পাতায় একটা নুপুর সেলাই করার মত করে আটকানো। অনামিকা
অবাক হয়ে যায় কারণ নূপুরটা অনামিকার যেটা ভার্সিটিতে
হারিয়ে গিয়েছিল এক অনুষ্ঠানে। অনামিকা নূপুরটা খুলে নেয়।
হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর দ্রুত পেজ উল্টায়।
আবার একটা পেজে আটকে যায় ও। লাল রঙ দিয়ে অনামিকা
লিখে রাখা হয়েছে। এটা কি আসলেই রঙ?? না, রঙ নয়,, তার
মানে রক্ত দিয়ে লেখা!! অনামিকার কৌতুহল বাড়তে থাকে, ওর
জন্য কেন কেউ নিজের রক্ত দিয়ে নাম লেখবে? পেজ উল্টায়
ও। এবার লেখা পায়। অনামিকা মনযোগী হয়ে ডায়েরী পড়া শুরু
করে।
.
আমি ছেলেটা নাকি খুব বোকা। অন্তত সবাই তাই বলে।
কারো সাথে ঠিকমত কথা বলতে পারিনা। কার সাথে কখন কি
বলব বুঝে পাইনা। আর কয়েকদিন পরেই ভার্সিটির ক্লাস শুরু
হবে। বাসা থেকে অনেক দূরেই আমার ভার্সিটি। বলা যায় অন্য
শহরে। হলে সিট পাইনি। পাবই বা কি করে? আমার তো
বড়ভাই নেই। ভার্সিটির পাশে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি, আমি
আর বিপ্লব। বিপ্লবের বাসা আমাদের পাশের জেলায়। ভর্তির
দিনে পরিচয় হয়।তারপর দুজনে আলাপ করে বাসাটা ভাড়া নেই।
বিপ্লব ছেলেটা বন্ধু হিসেবে ভালই। আমার ওকে ভালই
লেগেছে। লম্বা, ফর্সা ছেলে, মুখে ছোট ছোট দাড়ি আছে।
তবে রাগ বেশী, কিন্তু সেটা ক্ষনিকের জন্য। ওর রাগ থাকে
২-১ মিনিট। তারপর আবার সব ঠিক, ওর এই ব্যাপারটা আমি
ইনজয় করি খুব, ওকে রাগিয়ে দেই, তারপর মজা নেই।
.
আজকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ১ম ক্লাস করলাম। বিপ্লব
আর আমি পাশাপাশি বসেছি, দুই বন্ধু তো। স্যার অনেক ভাল,
অত্যন্ত বিনয়ের সাথে কথা বলেন। স্যারকে খুব ভাল লেগেছে
আমার। তবে সব ছাপিয়ে গেছে একটা মেয়ে। নাম এখনো
জানিনা।
স্যার ১ম দিন উপলক্ষ্যে একটু সহজ অধ্যায় বুঝাচ্ছিলেন।
ক্লাসের কিছুসময় পার হয়ে গেছে। এমন সময় হঠাৎ করে সে
আসল।হ্যা, সেই মেয়েটা, যার কথা বললাম একটু আগে। চোখে
চশমা, চুল ছাড়ানো, ফর্সা সুন্দর দেখতে। দেরী করে এসেই ও
চিৎকার করল, মে আই কাম ইন স্যার? স্যার কিছুটা বিষন্ন
হয়েই তাকালেন ওর দিকে,, সাথে সাথে পুরো ক্লাস তাকালো
ওর দিকে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে একবার সব ছেলেগুলোর
দিকে তাকালাম। সব কয়টা ছেলেই মুখ হা করে ওকে দেখছে,
বিপ্লব ও। স্যার ওকে কিছুক্ষন রাগ দেখালেন, কারন ও ১ম
দিনেই দেরী করে এসেছে। পরে ও এসে আমার সামনের সিটে
বসল। ক্লাসের সব ছেলেই ওকে মাঝে মাঝে দেখছে,, আমিও।
বুঝে গেলাম যে আজ থেকে ও ক্লাসের ক্রাশ হতে চলেছে। তার
সাথে আরো বুঝলাম যে আমি এর পিছনে ঘুরলে ও টাইম পাব
না। কারণ আমি বোকা ছেলে। ওর চুলের থেকে শ্যাম্পুর ঘ্রাণ
আসছে, আমি মোহে পড়ে যাচ্ছি, শুধু আমি না, বিপ্লব ও।
বেয়াদবটার গার্লফ্রেন্ড আছে। তবু হা করে আছে। আমি
কলমটা ওর মুখে ঢুকিয়ে দিলাম। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বিপ্লব
তাকালো আমার দিকে, ওকে দাবড় দিলাম, তোর না জি এফ
আছে?? ও কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু চুপ করে গেল। আর আমি
শ্যাম্পুর ঘ্রাণে খাতায় একটা ছড়া লিখে ফেললাম। নিজেকে
কবি কবি লাগছে খুব, প্রেমের কবি। তবে অবশ্যই বোকা কবি।
ছড়াটা ছিল,
"পাগল করল কন্যা আমায় চুলের ঘ্রাণে,
তখন থেকে চেয়ে আছি আমি তার পানে
কবি কি তাকে করেছে বর্ণনা কবিতা কিংবা গানে?
ভালবেসেছি কিনা আমি জানিনা, এই মনটাই সব জানে"
.
ছিঃ! কি বিশ্রি লিখেছিস এটা?? বিপ্লব বলল। আমি লজ্জা
পেলাম। কত রোমান্স নিয়ে লিখেছিলাম আর ও বলল কিনা
বিশ্রী!! তার উপর আবার বলল, মেয়েটাকে দেখে লিখেছিস
বুঝি?? ভালো মামা! তবে টাইম পাবিনা রে!! আমি আশাহত
হয়ে ওর দিকে তাকালাম। বিপ্লব সব দাঁত বের করে আমার
দিকে তাকিয়ে জঘন্য একটা হাসি দিল। ইচ্ছে করল দুই হাত
দিয়ে ওর মুখটা চেপে ধরি, হাতটাও বাড়ালাম কিন্তু পারলাম না।
.
এখন আপাতত আমার কাজ কম। ভার্সিটি আসি পুরোটা ক্লাস
ওকে চুরি করে দেখি, ও অবশ্য টের পায়না। টের পেলে
চোখাচোখি হত। তারপর কথা, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর প্রেম।
কিন্তু আমি বোকা ছেলে, দূর থেকে দেখাই আমার কাজ, তাও
চুপি চুপি দেখা। বাসায় আর এখন মন টেকে না। সারাদিন
ক্যাম্পাসে আসতে ইচ্ছে করে। ও হলে থাকে। ওর হলের সামনে
গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। অবশ্য নামটা এখনো
জানিনা। আসলে কাউকে জিজ্ঞেস করিনি ওর নামটা। সেদিন
বিপ্লবকে কথার ছলে জিজ্ঞেস করেছি, ও সেটা পেচিয়ে আমার
নাতী, নাতনির নাম ঠিক করেছে! বুঝেন নি?? আচ্ছা শুনুন,
ওকে বললাম, বন্ধু, ভাই আমার, হেল্প করো।,, বিপ্লব বলল,
কি? আমি ওকে দেখিয়ে নাম জানতে চাইলাম। বিপ্লব এটা শুনে
২ পা পিছিয়ে শুরু করল প্যাচাল! ওরে মামা, এই ব্যাপার? অন্য
কারো নাম তো জানতে চাও না। তবে?? প্রেমে পড়েছ? এখন
নাম জানবে, কাল কথা হবে, তারপর বন্ধু, অতঃপর প্রেম!!
মাম্মা,, ভালোই প্ল্যান করেছিস। চাকরী পেলে বিয়ে করবি
তাইতো? তারপর বাচ্চা হবে, সে বড় হবে। তার বিয়ে দিবি
দুইজনে, আমি গিয়ে দাওয়াত খাব। বাপরে?? কয়েক বছর পর
আবার নাতি নাতনি হবে!! খাওয়া দে এখনি। আমি অবাক হয়ে
বললাম, কিসের খাওয়া, আর এত কি বলছিস?? বিপ্লব বলল,
ট্রিট হবে বন্ধু, প্রেমে পড়েছ, ট্রিট দিবা না? চলো চলো,,,,।।
তারপর তো আমার পকেট ফাকা হলো। কিন্তু নাম জানা
হলো না। বিপ্লবের এই রি একশন দেখে আর কাউকে জিজ্ঞেস
করিনি।
.
ভার্সিটির অনুষ্ঠান, আমি উপস্থাপনার দায়িত্বে আছি।
আমার সাথে আমাদেরই ব্যাচের একটা মেয়ে মীম আছে।
বিপ্লবের পর ওর সাথেই আমার ফ্রেন্ডশিপ হলো। তাও
অনুষ্ঠানের বদৌলতে। ও হ্যা, মেয়েটার নাম জানতে পেরেছি
আমি কয়েকদিন আগে। ওর নাম অনামিকা। নামের মতই সুন্দর
মেয়েটা। না না উপমাটা ঠিক হলো না,,, ওর নামটা ওর মতই
সুন্দর। মাঝে মাঝে ওর সামনে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, মেয়ে,
বোকা ছেলেটা যে তোমাকে দেখে সেকি জানো? চশমা খুলে
আয়নায় নিজেকে দেখেছো?? দেখোনি বোধহয়। আমি জানি
তোমায় চশমা ছাড়া একটু বেশী ভাল লাগবে। চশমায় কেমন
যেন বড় আপু ভাবটা আছে।,,, যাহোক অনুষ্ঠানে অনামিকা নীল
শাড়ি পড়ে এসেছে। আমি স্টেজের কোণ থেকে অনেক্ষণ ওর
দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলাম, শুধু আমি না, অনেকেই দেখছিল
ওকে,, তবে আমি একটু বেশীই দেখেছি হয়ত, ধরা পড়ে গেছি।
পরে মাথা নিচু করেছি, এই প্রথম ওর চোখে চোখ পড়েছে
আমার। আমি কিছুক্ষনের জন্য লজ্জা পেলেও মনে মনে খুব
খুশি হয়েছি,, তার উপর মীম এর সাথে অনামিকার বন্ধুত্ব ভাল।
এটা আমার জন্য ভাল দিক।
একটু আগে অনামিকার পায়ের একটা নূপুর হারিয়েছে। ঠিক
হারিয়েছে না, ওর পা থেকে খুলে গেছে, এখন পাওয়া যাচ্ছেনা।
সবাই খোজাখুজি করল অনেক্ষন। কিন্তু পেলো না। মীম
বলল, নূপুরজোড়া নাকি অনামিকার খুব পছন্দের। মেয়েটা নাকি
বড্ড কষ্ট পেয়েছে। এখন আমার কর্তব্য হলো, ওর সামনে
গিয়ে ম্যাজিশিয়ান এর মত করে নূপুরটা খুঁজে দেয়া।কিন্তু আমি
তার বিন্দুমাত্র করলাম না।কারণ আমি ম্যাজিশিয়ান নই। এবং
এর চেয়ে বড় ব্যাপার হলো নূপুরটা এখন আমার প্যান্টের বাম
পকেটে অবস্থান করছে। বাসায় গিয়ে নূপুরটা কোথাও রাখতে
হবে। বিশেষ স্থানে, যেখানে দেখলে মনে পড়বে যে নূপুরটা
আছে। অনুষ্ঠানের শুরুতে অনামিকার হাসিমুখ দেখেছি, তবে
এখন প্রিয় নূপুর এর শোকে ওর মুখটা কেমন বিষন্ন হয়ে
আছে। আর আমি স্বার্থপরের মত ওর নূপুর পকেটে নিয়ে
ঘুরছি।
আজকের দিনটা আমার কাছে স্মরনীয়। আজকে ১ম অনামিকার
চোখে আমার চোখ পড়েছে। এবং ওর একটা প্রিয় জিনিস
আমার কাছে আছে। নূপুরটা আমি ডায়েরীতে সুতা দিয়ে সেলাই
করার মত করে রেখেছি। আমি বোকা ছেলে, তাই কথা বলতেও
পারিনা ওর সাথে, এজন্য আর নূপুর ফেরত দিতেও গেলাম না।
বিপ্লব এসবের কিচ্ছু জানেনা। ও জানলে সমস্যা হবে তাই ওকে
বলিনি।
.
ভার্সিটি জীবনের এই বছরগুলো অনেক মজা করেই কাটলো।
তবে আজকের দিনটা নয়। অনামিকাকে একটা ছেলে প্রপোজ
করেছে, ও হেসেছিল কিছুক্ষণ, তারপর কিছু বলেনি। চলে গেছে
সেখান থেকে, মনে হয় হ্যা বলে দিবে। আমি তখন ব্রেঞ্চে বসে
কলম দিয়ে হাত ফুটো করে ফেলেছি, অনেকগুলো ফুটো হয়ে
গেছে,, বিপ্লব হঠাৎ করে আমার এই অবস্থা দেখে এসে হাত
চেপে ধরে, পরে পাশের ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে ব্যান্ডেজ করে
আনাল।আমি এখন বাসায় বসে ডায়েরীটাতে এসব লেখছি।
আবার হাত কাটতে ইচ্ছে করছে। পাশে একটা ব্লেড ছিলো।
হাতটা কাটলাম, রক্ত বের হচ্ছে, আমি পিশাচের মত করে
নিঃশব্দে হাসছি। ডায়েরীর একটা পাতায় লিখলাম আমার রক্ত
দিয়ে,,, অনামিকা। চোখ গুলো ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি কি
মরে যাচ্ছি?? রক্তক্ষরন বেশি হয়ে গেল? বিদায় তাহলে
পৃথীবিকে।
চোখ মেলে নিজেকে আবিস্কার করি হাসপাতালে। সেটা বড়
কথা নয়, বড় কথা হলো আমি যে অনামিকার প্রতি কতটা
দুর্বল সেটা বিপ্লব জেনে গেছে। এইত কিছুক্ষন আগেও সেটাই
বলে গেল। তার সাথে আরো বলে গেল যে অনামিকা কিছুদিন
বাদেই বিদেশে চলে যাবে। কথাটা শুনে বুকটা কেমন করে
উঠেছিল, অবশ্য অনার্স শেষ করে সবাই আলাদা হবে। তবুও
কেন যেন মনে হচ্ছিল আমি ওকে হারিয়ে ফেলছি। ইসস যদি
ওকে আটকাতে পেতাম। বিপ্লব এসে কানের কাছে একটা কথাই
বলেছিল, এত ভালবাসিস তো বললি না কেন বোকা? আর তো
পাবিনা ওকে।"
সামনের সপ্তাহেই অনামিকা চলে যাবে শুনলাম। এখন আমি
শারিরীক ভাবে সুস্থ। তবে মনের দিক দিয়ে অনেকটা অসুস্থ
আমি। সেটা আমি ছাড়া কেবলমাত্র বিপ্লব জানে। ও ইদানিং
আমাকে অনেককিছু করতে বলে, এইত সেদিন দুজনে রাতে
অনামিকার বাসার সামনে থেকে ঘুরে এলাম। ও বলল, চিৎকার
করতে, আমি করিনি। আমার মত বোকা ছেলেটাকে দিয়ে
আজকাল বিপ্লব অনেককিছু করাচ্ছে। আমি নিজেই অবাক হই
এসব করে করে। বিপ্লব আমাকে বুদ্ধি দিয়েছে অনামিকা যাবার
দিন যেন ওর বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে সব বলি। কিন্তু আমি
সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা করব না।ওকে কষ্ট দিব না আমি।
ডায়েরীতে আর কিছু লেখা নেই। চোখের কোণায় পানি আসার
মত হয়েছে। অনামিকা গাড়ির জানালাটা খুলে দিলো, হালকা
বাতাস আসছে। কেমন যেন ঘোর লাগছে নিজের ভিতর। আচ্ছা
অরন্য তো আতেঁল নামেই পরিচিত ছিল, তবে অরন্য পাশে
থাকলে মাঝে মাঝে মনে হত ও অনামিকার দিকে তাকিয়ে আছে,
কিন্তু সেরকম কখনোই অনামিকা ধরতে পারেনি।তাহলে???
ছেলেটা ওকে এতটা ভালবাসে?? ওর জন্য কি থাকা যায়না
এখানে?? কিন্তু ও কি জানে অনামিকা চলে যাচ্ছে,, ও কি
আসবে এয়ারপোর্ট এ? অনামিকা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়,অরন্য
একবার ওকে ডাকলেই ও আর বাইরে যাবেনা। দৌড়ে এসে
অরন্যকে জরিয়ে বলবে, এতটা ভালবাসো কেন? আর
ভালবাসলে বলতে পারোনা কেন? বোকা ছেলে???
গাড়ি এয়ারপোর্ট এ এসে গেছে। অনামিকা গাড়ি থেকে নেমে
চারপাশে তাকাচ্ছে, যদি অরন্য আসে,, অনেকক্ষন তাকিয়েও
লাভ হয়না। কারণ অরন্য আসেনি। অনামিকা আবারো মন
খারাপ করে।টিকিটের যাবতীয় কাজ শেষ করে অনামিকা
এয়ারপোর্ট এ ওয়েটিং রুমে বসে আছে। কোনো দিকেই ওর
ভাল লাগছে না।মন একদম খারাপ। ডায়েরীটা পরার পর থেকে
মনটা আনচান করছে।
অরন্য কি সত্য্যি আসবে না। উফ, অনামিকা নিজের উপর
নিজেই বিরক্ত হয়। এই ছেলেটাকে নিয়ে ওর কখনো কোন
চিন্তার উদ্রেক হয়নি। অথচ এখন ও অনামিকার মাথায় চেপে
বসেছে। অনামিকা বুঝতে পারেনা কি করবে। বাসায় চলে যেতে
ইচ্ছে করছে। আবার যে কারণে বাইরে যাচ্ছে, সেটা না করা কি
ঠিক হবে? এটা ভেবেও খারাপ লাগছে। টিভিতে গান চলছে,
ফালতু একটা গান। অনামিকা প্রচন্ড স্ট্রেসে মাথা চেপে ধরে
বসে থাকে। ওর কেন যেন মনে হয় ভুল করতে চলেছে ও, বিরাট
ভুল।
.
পাশের কেউ একটা নিউজ চ্যানেল দেয়। সাংবাদিকের কথা
শোনা যাচ্ছে, অনামিকা কান চেপে রাখলেও কথা গুলো শোনা
যাচ্ছে। অনামিকা বিরক্ত বোধ করে,, টিভির কথা গুলো ঠিক
এরকম,, " দেখুন দর্শক, পাগল প্রেমিকের কান্ড, প্রেমের টানে
মানুষ কত কি করে, তারই নমুনা দেখুন। ভালবাসার মানুষটাকে
দূরে যাওয়া হতে আটকানোর প্রচেষ্টারত প্রেমিক। পাশে থেকে
চিৎকার উঠে, "অনামিকা, আমি বিপ্লব, আমাকে তো চিনো।
অরন্য ছাগল টা তোমাকে ভালবাসে, আমরা এয়ারপোর্ট এর
বাইরে,, তুমি কোথায়....!! "
.
অনামিকা বসা থেকেই চট করে উঠে দাঁড়ায়। টিভিতে দেখে
অরন্য একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দারিয়েছে, তাতে লেখা Don't
leave me Anamika.I love u. অনামিকা অরন্যর কান্ড
দেখে হেসে ফেলে। তারপর এক দৌড়ে বাইরে চলে আসে।
বিপ্লব অনামিকাকে দেখেই অরন্যকে চিৎকার করে, ওই তো
এসে গেছে। অরন্য অনামিকার সামনে যায় আস্তে আস্তে।
অনামিকার কেমন যেন আনন্দ লাগে। এই বোকাসোকা ছেলেটা
ওর জন্য এত পাগলামি করতে পারে। ইসস, সবাই দেখছে,
অনামিকার লজ্জা লাগছে তবু দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। অরন্য
এখন একদম ওর সামনে। প্ল্যাকার্ড উচু করে ধরে আছে ।
অনামিকা জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবা?,,, অরন্য বলে, হু,,
অনামিকা আবার বলল, বলো। অরন্য উত্তর দেয়,, প্লিজ যেও
না। অনামিকা জিজ্ঞেস করে, আর কিছু। অরন্য মাথা নিচু
করে।হঠাৎ করে অরন্য একটা কাজ করে বসে,,অনামিকাকে
জড়িয়ে ধরে।অনামিকা প্রথমে বিব্রত বোধ করলেও সবার
হাততালি দেয়া দেখে সাহস পায়। চোখে পানি চলে আসে ওর,
এই বোকাটার পাগলামি দেখে। অনামিকাও জড়িয়ে ধরে
অরন্যকে পরম ভালোবাসায়।