Forums.Likebd.Com

Full Version: রাখে আল্লাহ মারে কে ?
You're currently viewing a stripped down version of our content. View the full version with proper formatting.
বাদশাহ হারুনুর রশীদের যুগের কথা। বাগদাদে এক ব্যবসায়ী
যুবক ছিল। দেহে তার ভরা যৌবন ছিল। পরিবারে ছিল অর্থের
প্রাচুর্য। ভোগ-সামগ্রী সব ছিল তার হাতের মুঠোয়। তার
দোকান ছিল সাগরতুল্য; তাতে স্বর্ণ-রূপার স্তুপ ছিল। তার
বাড়ি ছিল স্বর্গ-তুল্য; নহর সমূহ প্রবাহিত হত যার তলদেশ
দিয়ে। ডাগর নয়না ৫০টি হুর দিয়ে যা শোভিত ছিল। কিন্তু এত
কিছুর মাঝেও যুবকটি জীবনের স্বাদ ও সজীবতা খুঁজে পাচ্ছিল
না। হৃদয়ের তৃপ্তি ও পরিতৃপ্তির নাগাল পাচ্ছিল না। এরই মধ্যে
একদিন সে গোলাম বাদীর হাটে গিয়ে এক অসম্ভব সুন্দরী বাদি
দেখতে পেল। যে কল্পনার তুলিতে আঁকা প্রিয়তমার চেয়ে ও
অধিক সুন্দর ও মধুর ছিল। টানা টানা নীলাভ চোখ দুটোতে
ছিল তার মায়াভী আকর্ষণ। চেহারায় ছিল তার শিশির ভেজা
পাহাড়ী পদ্মফূলের স্নিগ্ধতা ও পবিত্রতা। একপলক দেখেই
যুবকটি তার প্রেমের জালে আটকে গেল। ফলে নির্ধারিত মূল্যের
চেয়ে বহুগুণ বাড়িয়ে সে বাদীটিকে কিনে আনল। এত দিনে তার
যৌবন সাগরে উথলা টেউ উঠল। তৃপ্তির আনন্দে প্লাবিত
হলো তার হৃদয়। সে এখন সর্বক্ষণ তাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
তার ভালোবাসার অথৈ সাগরে ডুবে থাকে।
কিছু সময়ের জন্য সে দোকানে যায় এতেও তার ধৈর্যের বাঁধ
ভেঙ্গে যায়। ভালোবাসার অনিরুদ্ধ টানে আবার সে দ্রুত ফিরে
আসে প্রিয়তমার আঙ্গিনায়। দিন যতই বয়ে যেতে লাগল,
প্রিয়তমার প্রতি আশক্তি ততই বাড়তে লাগল। অনিবার্য
কারণে ব্যবসার প্রতি অনীহা ও অনাশক্তিও প্রকট আকার
ধারণ করতে লাগল। ফলে তার দীর্ঘ দিনের বিশাল ব্যবসা তিলে
তিলে খয়ে যেতে লাগল। স্ত্রী যখনই তাকে ব্যবসার প্রতি
মনোযোগী হওয়ার কথা বলত তখনই সে বলত, সম্পদ দিয়ে
আমি কী করব? তুমিইতো আমার মূলধন। আমার ব্যবসা,
আমার মুনাফা। এক পর্যায়ে তার সেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের
অবনতি তলানিতে গিয়ে ঠেকল। মূলধন নিঃশেষ হয়ে গেল।
দোকানের সামগ্রীগুলো পর্যন্ত অন্যের হাতে চলে গেল।
সুন্দরী বাদীগুলোও বাজারে তুলতে হলো। এরপর বিক্রিরমত
যখন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকলনা তখন সে বাসগৃহটিই ভেঙ্গে
বিক্রি করতে লাগল। এখন তার নীচে শক্ত মাদুর উপরে ছনের
ছাউনি ঝড় বৃষ্টিতে বীভৎস মাখামাখি। এত শূন্যতা ও
অপূর্ণতার মাঝেও তার হৃদয় ছিল তৃপ্তিতে পূর্ণ। ক্ষুধ-
পিপাসায় প্রিয়তমার দর্শনই ছিল তার অমৃত খাদ্য। দুঃখ-
দুর্দশায় জীবনসঙ্গিনীর অকৃত্তিম ভালোবাসাই ছিল তার
অবর্ণনীয় প্রাপ্য।
ওদিকে ভালোবাসার বৃক্ষে এক সময় ফল এসে গেল। একে একে
তা কাটার সময় ও ঘনিয়ে এলো। কিন্তু তা নির্ধারিত সময়
পেরিয়ে অসময়ে আগমন করতে যাচ্ছে। আনন্দমুখর বসন্তে তার
দেখা মেলেনি। আসেনি আলো ঝলমল সুন্দর প্রভাতেও। বরং
সে আগমন করছে প্রচন্ড শীতের অন্ধকার রজনীতে। দুঃখ
দারিদ্রে বিধ্বস্ত দুর্ভিক্ষে। অর্ধরাতে স্ত্রীর প্রসব বেদনা
শুরু হয়ে গেল। শক্ত চাটাইয়ে শুয়ে সে যন্ত্রণায় ছটফট করতে
লাগল। প্রসব বেদনা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগল। ভগ্ন
কবাটের সামনে দাঁড়িয়ে সেও অনুভব করছিল প্রিয় স্ত্রীর
কঠিন যন্ত্রণা। কিন্তু এই কষ্ট যে ভাগ করে নেয়ারমত নয়।
যন্ত্রণা যখন অসম্ভব বেড়ে গেল স্ত্রী তখন তাকে ডেকে
বলল, আমি আর পারছিনা। তুমি আমার জন্য দ্রুত সামান্য
মধু, কিছু আটা আর তৈল নিয়ে এসো। দেরি করলে কিন্তু
আমাকে আর পাবেনা। সে পাগলেরমত ছুটে বেরিয়ে গেল। কিন্তু
এত রাতে সে কোথায় কার কাছে যাবে? সমগ্র পৃথিবী এখন
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চতুর্দিকে নিকষ কালো অন্ধকার আর
কবরের নিরবতা বিরাজমান। হাতে পয়সা-কড়ি নেই বাজারে
দোকান পাটও খোলা নেই। কীভাবে সে প্রিয়তমার ক্লিষ্ট
মুখে হাসি ফোটাবে? দৌড়াতে দৌড়াতে সে দজলা নদীর
ব্রিজের কাছে পৌঁছে গেল। নিজেকে বড় নিঃস্ব-অসহায় মনে
হচ্ছে। এমন কঠিন মুহূর্তে প্রিয়জনকে সাহায্য না করতে পারার
অসহ্য যন্ত্রণা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। যার ভালোবাসার
সাগরে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে আজ সে সর্বহারা হয়ে গেছে সেই
প্রিয়তমাই আজ তাকে ছেড়ে অনন্তকালের জন্য পরপারে চলে
যাওয়ার দ্বার প্রান্তে পৌঁছে গেছে। কথাটা মনে পড়তেই
হৃদয়য়ের কোথায় যেন তার চিল চিল করে উঠে। তাকে ছাড়া
নিঃসঙ্গ জীবন সেতো কল্পনাতীত। ইচ্ছা করছে এখনই ব্রিজ
থেকে ঝাঁপ দিয়ে জীবন যন্ত্রণা থেকে চিরমুক্তি লাভ করতে।
রাতের অখন্ড নিরবতায় হৃদয়ের দুঃখ-বেদনাগুলো জীবন্ত হয়ে
তাকে চেপে ধরতে লাগল। এখন দুঃখের শিকল থেকে মুক্তি
পাওয়ার মৃত্যুই তার একমাত্র ভরসা।
শেষ বারেরমত সে ভগ্ন হৃদয়ে প্রভুর দরবারে হাত তুলে বলল,
হে আল্লাহ আমি তোমার কুদরতি হাতে সপে দিলাম। তুমি
তাদেরকে রক্ষা করো, তাদের প্রতি দয়া করো। দোআ শেষে
সে খরস্রোতা দজলায় ঝাঁপ দেয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগল। ঠিক
এই মুহূর্তে সে তার শোকাচ্ছন্ন হৃদয়ের বদ্ধ দ্বারে ধর্মীয়
চেতনার কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেলো। নিঃশব্দ আওয়াজে
স্পষ্ট ভাষায় কে যেন তাকে সতর্ক করে গেল। এবং তাকে স্মরণ
করিয়ে দিল আত্মহত্যার ভয়াবহ পরিণাম ও পরিণতির কথা।
সাথে সাথে সে নিজেকে সংবরণ করে নিল এবং মৃত্যুর ঘাট থেকে
জীবনের নৌকা দ্রুত সরিয়ে নিয়ে এলো। ওদিকে মসজিদ থেকে
মুয়াজ্জিনের সুমধুর কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে লাগল। সে তখন
রিক্ত হস্তে বাড়ির পথে পা বাড়াল। বাড়িতে প্রবেশ করতেই
প্রতিবেশি মহিলাদের কোলাহল তার কর্ণ ভেদ করল। সাথে
সাথে হৃদয়টা তার ধুক করে উঠল। কাছে এসে সে তাদের কাছে
স্ত্রীর খবর জানতে চাইল। অজ্ঞান প্রসুতিকে মৃত ভেবে তারা
তাকে মুত্যুর সংবাদ দিল। দুঃখে-ক্ষোভে সে নিজের চেহারায়
চপেটাঘাত করতে লাগল। এবং সেখান থেকে উল্টো পথে
অজানার উদ্দেশ্যে-পা চালালো। গ্রামের পর গ্রাম শহরের
পর শহর পেরিয়ে অবশেষে সে খোরাসানে গিয়ে স্থির হলো।
সেখানে সে পরিচিত এক লোকের সাক্ষাৎ পেলো। সে তার
প্রতি-সর্ব প্রকার সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করে দিল।
তার সান্ত্বনা ও অনুগ্রহে সে আবার স্বাভাবিক জীবন ফিরে
পেল। প্রিয়তমার স্মৃতি ভুলে যাওয়ার জন্য সে নিজেকে কাজের
মধে ব্যস্ত করে রাখল। ধীরে ধীরে আবার সে ব্যবসার পথ ধরে
দূরন্ত গতিতে উন্নতি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যেতে লাগল।
দিন দিন তার ব্যবসায় প্রভূত উন্নতি হচ্ছিল এবং চতুর্দিক
থেকে দু-হাত ভরে অর্থ আসছিল। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সে
পূর্বের অর্থনৈতিক অবস্থান ফিরে পেল। পণ্য-সামগ্রীতে
দোকান ভরে গেল। বাড়িটাও সবকিছুতে পূর্ণ হয়ে গেল। কিন্তু
এবারও সে একই সমস্যার আবর্তে পাক খেতে লাগল। চতুর্দিকে
পূর্ণতার ছড়াছড়ি কিন্তু হৃদয় জুড়ে মরু-সাহারার শূন্যতা
হাহাকার করতে লাগল। তবে এবার শূন্যতা পূরণের ন্যূনতম
গুরুত্বও তাকে স্পর্শ করতে পারল না। বরং নিঃসঙ্গ জীবনের
বেদনার আনন্দই তাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। সম্প্রতি
বার্ধক্যের শুষ্ক বাতাস আঘাত হানতে শুরু করেছে তার জীবন
নাওয়ের পালে। ক্রমশ মৃত্যুর সংকেত ভেসে উঠছে তার চুল,
দাড়ি, গোঁফে। মৃত্যুতে তার আপত্তি নেই। কিন্তু প্রিয়তমার
পার্শে শয়নের এক অদম্য বাসনা দিন দিন তার ভেতর প্রবল
থেকে প্রবলতর হতে লাগল। হৃদয়ের তাড়ণায় তাড়িত হয়ে
অবশেষে সে তার বিশ বছরের অর্জিত সকল পণ্য-সামগ্রী
বিক্রি করে দিল এবং একটি বাহন ক্রয় করে বাগদাদ অভিমুখী
এক কাফেলার সাথে রওনা হয়ে গেল। এখন তার একটাই আশা ও
প্রত্যাশা, কষ্টার্জিত অর্থগুলো দিয়ে বিশাল এক সমাধি
নির্মাণ করে তাতে প্রিয়তমার সাথে পরকাল যাপন করা। কিন্তু
তার আশার গুড়ে বালি পড়ল। ভাগ্য তাকে আবারও বঞ্চনা
করল।
রাতের বেলায় তারা একটি দস্যু দলের কবলে পড়ল। ডাকাতরা
তাদের সকলকে হত্যা করে সমুদয় মাল লুটপাট করে নিয়ে গেল।
ভাগ্যক্রমে সে আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যায়। জ্ঞান ফিরে
পেয়ে সে ক্ষত-বিক্ষত দেহটাকে টেনে তুলে ধীরে ধীরে চলে
আসে। ক্লান্তি ও শান্তিতে তার পূর্ণ দেহই যেন জমে যাচ্ছে।
ক্ষুধ-পিপাসায় প্রাণটা কণ্ঠনালী অতিক্রম করতে যাচ্ছে।
চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। হঠাৎ সে নদী-বক্ষে একটা
ভেপুর আওয়াজ শুনতে পেল। ক্লান্ত আখিদ্বয় মেলে সে দেখতে
পেলো একটা যুুদ্ধ জাহাজ এদিকেই আসছে। নব-জীবনের এক
চিলতে আনন্দ তার শিরা-উপশিরায় বয়ে গেল। জাহাজটি যখন
নিকটে চলে এলো তখন সে ইশারা করে সর্বশক্তি দিয়ে ডাকতে
লাগলো। অসহায় দুর্বল মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা
আরবদের ঐতিহ্যগত রীতি। জাহাজের কমান্ডার জাহাজ
ভিরানোর নির্দেশ দিলেন। জাহাজে তুলে প্রথমেই তার
খাবারের ব্যবস্থা করলেন। এরপর কোন প্রকার জিজ্ঞাসাবাদ
ছাড়াই বিশ্রামের জায়গা করে দিলেন। বিছানায় গা এলিয়ে
দিতেই রাজ্যের ঘুম এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। যখন ঘুম ভাঙ্গল
তখন আকাশ পরিস্কার হয়ে গেছে। বাগদাদের বাড়িঘর চোখে
পড়ছে। নাবিক তাকে সেই ব্রিজের কাছে নামিয়ে দিল। যেখানে
দাঁড়িয়ে সে একদিন শোকে-ক্ষোভে আত্মহত্যার প্রস্তুতি
সম্পন্ন করেছিল। মুহূর্তেই সে হৃদয়ের জানালা দিয়ে হারিয়ে
গেলো স্মৃতির উদ্যানে। একে একে তার চোখের সামনে ভেসে
উঠতে লাগল দুঃখ-সুখের সব স্মৃতি।
মাঝ খানের এই সময়টা তার কাছে এক মুহূর্তেরমত মনে হচ্ছিল।
অথচ এরই মধ্যে পৃথিবীর কত ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট সব বদলে গেছে। পরিচিত অনেক চেহারা
এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে। সবকিছুই এখানে তার অচেনা অজানা
লাগছে। এসব চিন্তা করতে করতে সে পৌঁছে গেল রেখে যাওয়া
সেই ভগ্নাবশেষ বাড়ির কাছে। এখানে এসে আবার তার হৃদয়টা
আহত হলো। যেই বিধ্বস্ত বাড়িতে সে প্রিয়তমাকে রেখে চলে
গিয়েছিল সেখানে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে বিশাল প্রাসাদ। গেটে
দন্ডায়মান রয়েছে সৈন্য ও চাকর নওকরের দল। প্রিয়তামার
পাশে একটু শান্তিতে শায়িত হওয়ার যে আশা নিয়ে সে সুদূর
খোরাসান থেকে বহু কষ্ট স্বীকার করে এখানে এসেছে, তার
সেই শেষ আশাটুকুও বুঝি আর আলোর মুখ দেখতে পাবে না।
উদাস নয়নে সে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল। হঠাৎ তার দৃষ্টি
পড়ল, একটা মুদির দোকানের উপর। সে আগে থেকেই এটা
চিনত। শত বিবর্তনের মাঝেও বহু সংগ্রাম করে দোকানটা
এখনও অতীতের অবকাঠামোতেই স্থীর হয়ে আছে। সে দ্রুত
ছুটে চলল সেদিকে। দোকানে বসা ছিল যুবক বয়সের এক ছেলে।
সে তার কাছে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল, তার ভগ্নাবশেষ
বাড়ির উপর যেই প্রাসাদটি মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা
হলো বাদশা মামুনের কোষাধক্ষ ও ধাত্রীমাতার সন্তানের।
প্রাসাদের মালিকের এক বিস্ময় ইতিহাসও সে জানতে পারল
তার কাছ থেকে। তা হলো; লোকটির পিতা ছিল একজন
প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। হঠাৎ সে একটি অপরূপা বাদী ক্রয় করে
তার প্রেম-সাগরে ডুবে যায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা
একেবারেই ভুলে যায়। ফলে অল্প কদিনেই তার ব্যবসার সূচক
শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। ধীরে ধীরে সে রিক্ত-হস্ত,
নিঃস্ব- সর্বস্ব ফকিরে পরিণত হয়ে যায়। একদিন সেই স্ত্রীর
প্রসব বেদনা শুরু হয়। রুক্ষ মাদুরে শুয়ে সে যন্ত্রণায় ছটফট
করতে থাকে। লোকটি তার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস
আনতে বাহিরে যায়। সেই যে বের হয়েছে আজ পর্যন্ত সে আর
বাড়িতে ফিরে আসে নি। এদিকে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে
প্রসূতি এক ফুটফুটে সন্তান জন্ম দেয়। স্বামীহারা হতভাগা
স্ত্রী সেই সন্তানকে অবলম্বন করে দুঃখে-সুখে জীবনের ঘানি
টেনে নিতে থাকে। এর কিছুদিন পরই বাদশা হারুনুর রশীদের ঘরে
এক নবজাতকের জন্ম হয়। সর্বত্র তার জন্য ধাত্রীর
অনুসন্ধান শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আশ্চর্য! সে কারও স্তনে
মুখই দিচ্ছেনা। পরে বাদশাকে এই অসহায় নারীর সন্ধান দেওয়া
হয়। সাবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে নবজাতক তার দুগ্ধ পান
করতে শুরু করে। সেই নবজাতকই হলো আজকের খলিফা মামুন।
ঘটনার বিবরণ শুনে লোকটির মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবী যেন
তাকে নিয়ে লাঠিমেরমত ঘুরছে। নিজের কানকেই যেন সে
বিশ্বাস করতে পারছেনা। সে আবার যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করল,
ছেলেটির মা কি এখনও জীবিত আছে? যুবকটি ইতিবাচক উত্তর
দিয়ে বলল, সে বেঁচে আছে বটে কিন্তু স্বামী হারানোর অসহ্য
বেদনায় বিধ্বস্ত হয়ে গেছে তার জীবন।
লোকটি এবার তাকে ছেড়ে ছুটে চলল, সেই প্রাসাদের দিকে।
আনন্দের অতিশয্যে প্রাণ তার ওষ্ঠাগত। পুনঃমিলনের
অনাকাক্সিক্ষত আনন্দে হৃদয় তার প্লাবিত। মুহূর্তেই সে ভুলে
গেল অতীতের সকল দুঃখ-কষ্টের কথা। হতাশা ও দুর্দশার
কথা। মহান প্রভুর প্রতি কৃতজ্ঞতায় আখিদ্বয় তার ছলছল
করে উঠল। কত মহান তিনি, কত অসীম ক্ষমতার অধিকারী
যিনি এখনও তার প্রিয়তমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, রক্ষা করেছেন
তার সন্তানকে। আজ সেই সন্তান কত বড় হয়েছে। কত সম্মান
ও মর্যাদায় ভূষিত হয়েছে। এসব ভাবতেই আনন্দে হৃদয় তার
উড়ে যেতে চাচ্ছে। সে আজ হারিয়ে ফেলেছে আনন্দ প্রকাশের
ভাষা ও ভঙ্গি।
ছুটতে ছুটতে সে যখন বাড়ির মালিক যুবকটির কাছে পৌঁছল
তখন সে তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করল। সন্তানের সামনে
দাঁড়িয়ে লোকটির হৃদয়-স্পন্দন অসম্ভব বেড়ে গেল। সে উত্তর
দেয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলল, জড়তামাখা কণ্ঠে সে শুধু বলল,
‘আমি তোমার সেই হারানো পিতা’। যুবকটি এবার সন্দেহের
দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল এবং বলল, আপনি আপনার দাবিতে
সত্যবাদী হয়ে থাকলে চলুন আমার সাথে। বাপ-বেটা এবার
রওয়ানা হলো অন্দর মহলের দিকে। ছেলেটি মায়ের কামড়ার
কাছে গিয়ে তাকে বাহিরে রেখে ভেতরে চলে গেল। এদিকে
লোকটির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। সে প্রিয়তমার নাম ধরে
চিৎকার করে উঠল। সাথে সাথে পর্দা নড়ে উঠল। বৃদ্ধপ্রায়
মহিলাটি ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো। এবং তার গলা জড়িয়ে
ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল আর পাগলেরমত হাসতে লাগল।