Forums.Likebd.Com

Full Version: মহানায়ক আপনি শুধু চলচ্চিত্র নয়, আমাকেও শুন্য করে দিয়ে গেলেন!
You're currently viewing a stripped down version of our content. View the full version with proper formatting.
আমি চলচ্চিত্রাঙ্গনের কেউ নই, তবুও আমার সবটুকু শ্রদ্ধা ও ভালবাসা দিয়ে তাঁর অভিনয় প্রতিভাকে লালন করেছি আমার মধ্যে। তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখার সুসৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সব মিলিয়ে ৪/৫ বার, শেষবার দেখেছিলাম ২০১৫ সালে ২৩ শে জানুয়ারি। বিএফডিসিতে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি আয়োজিত ‘নায়করাজ রাজ্জাক এর ৭৫তম জন্মদিন’ অনুষ্ঠানে।উপস্থিত ছিলেন অনেক নামিদামী চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা/অভিনেত্রী, প্রযোজকসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী। সত্তোর্ধ একজন অভিনেতা কতটা দাপুটে আর ঐশ্বরিক শক্তিমান হলে সব প্রজন্মের দর্শক তাঁকে মনে রেখেছে সেদিন বুঝেছিলাম। তাঁকে এক নজর দেখার জন্য উপচে পড়া ভিড় ছিল সেদিন।

জীবন থেকে নেয়া গল্পই বলে দেয় নাচের পুতুল কতটা বাস্তবসম্মত। নীল আকাশের নীচে আজ রাজ্জাক শূন্যতা। স্লোগানমুখর বাঙালি আজ স্তব্দ, হৃদয়ে আমার জন্মভূমি, চোখের জলে রাজ্জাক এর জীবনের ‘ছুটির ঘণ্টা’ বেজে গেছে আজ! বিষাদের ছায়া বয়ে বেড়াচ্ছে সমগ্র বাঙালি অবাক পৃথিবী । নায়করাজ নেই, তাঁর পদচারনায় আর কোনদিন প্রানচাঞ্চল্ল্য ফিরে পাবে না বিএফডিসি। যেখানে ‘অবুঝ মন’ নিয়ে ‘আলোর মিছিল’ জ্বালিয়েছিলেন তিনি।

নায়ক রাজরাজ্জাক একজন ব্যক্তি বা অভিনেতা নন। বাংলা চলচ্চিত্র উপাখ্যান।

ঠিক কবে কখন বাংলা সিনেমা প্রীতি বা আসক্তি আমাকে স্পর্শ করেছে, সে দিন তারিখ মনে করে বলা মুশকিল। আমার বয়স কতই বা হবে - ন’-দশ, হয়তো আরও কম। তবুও যাকে দেখে প্রথম চলচ্চিত্র ভালবাসি, তিনি রাজ্জাক। কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী থানায় আমার জন্ম। ছেলেবেলাটা কেটেছে সেখানে। আমাদের বাড়ি লাগোয়া মুকুল সিনেমা হল। মাঝখানে ১০০ গজ দূরত্ব। হলের মালিক সম্পর্কে আমার নানা। আমাদের আশেপাশে দ্বিতীয় কোন বসতি নেই। নানাদের প্রচণ্ড আদরে বড় হয়েছি। বাড়ির বাইরে বের হওয়া মানেই দৌড়ে নানার কাছে চলে যাওয়া। হলের দায়িত্বে থাকা ম্যানেজার টিকেট বিক্রেতা থেকে শুরু করে নিয়মিত সিনেমা দেখতে আসা দর্শকদের কাছে আলাদা গুরুত্ব পেতাম। হলের সামনে দেখামাত্রই তারা ডেকে বলতেন ভেতরে চলে যাও। টিকেট চেকার হাতে থাকা টর্চ লাইটের আলোয় একটা ভালো সিট খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে যেতেন। তখন মহিলাদের জন্য আলাদা বসার কেবিন ছিল। ওখানে একটা সিট জুটে যেতো অনায়সেই! সম্ভবত বিনে সুঁতোয় গাঁথা এসব স্মৃতিই আমার সিনেমা প্রেমকে দ্বিগুণ উস্কে দেয় নিয়মিত!

রাজ্জাক প্রসঙ্গে ফিরি আবারো!

ছুটির ঘণ্টা সিনেমাটি মূলত আমার ব্রেনে গেঁথে যায়। যদিও তা কখনোই আমার স্মৃতিতে সুখের নয়, আর্তনাদ ও বিষাদের। অশিক্ষিত ছবিটি দেখে কতবার যে নিজেকে মাস্টার সুমন কল্পনা করেছি তার হিসাব নেই। ছুটির ঘণ্টা ও অশিক্ষিত ছবি দিয়েই আমি একজন অভিনেতা রাজ্জাককে চিনেছিলাম। যখন স্কুলে পড়ি তখন প্রিয় নায়ক-নায়িকার ভিউ কার্ড সংগ্রহ করতাম। সেইসময়ে নায়ক রাজ্জাকের সপরিবারে তোলা একটি ছবি ভিউকার্ড আকারে বের হয়েছিল। আমার সংগ্রহেও ছিল ভিউকার্ডটি। আরো পরে রাজ্জাক-ববিতা অভিনীত ‘অমর প্রেম’ দেখে রাজ্জাকের প্রেমে পড়ি। সেই থেকে তিনি আমার স্বপ্নের নায়ক। শ্রদ্ধা ও সম্মানের চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব।

আমার বন্ধু চলচ্চিত্র উপস্থাপিকা হাস্নাসহ মাত্র সপ্তাহখানেক আগেই প্ল্যান করছিলাম রাজ অভিনেতা মহানায়কের আগামি জন্মদিনে তাঁকে ট্রিবিউট করে একটা মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করবো। অভিনয় করবে অভিনেতা রহমতউল্লাহ্‌ ও আমার ছেলে দীপ্র। আমার কৈশোরে দেখা স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে- মাস্টার সুমন চরিত্রে দীপ্র। কস্টিউম, লোকেশন নিয়ে নানান কল্পনা চলছে। প্রতিদিন নিয়ম করে দীপ্রকে ‘অশিক্ষিত’ ছবির ইউটিউব লিঙ্ক দেখাই। রাজ্জাক ও মাস্টার সুমন অভিনীত গান- 'রহমত ভাই তোমায় নাম দস্তখত শেখাতে চাই। কোনদিন কেউ যেন বলতে না পারে তোমার কোন বিদ্যা নাই...... ও রহমত ভাই'। গানটি নতুনভাবে নির্মাণ করবো সে ভাবনা থেকে রাজ্জাক সম্পর্কে ওকে একটু একটু করে প্রতিদিন বলতাম। গত কয়েকদিনে দীপ্র রাজ্জাককে চিনে ও জানে। গতকালও স্কুল থেকে আসার পর রাতের খাবার খেতে খেতে ইউটিউবে গানটি দেখছিলো। আজ সকালে স্কুলে যাবার পথে দীপ্রকে বললাম- বাপজি, কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। জানি না এমন মহাকর্মণ্য দ্বিতীয়বার পুনর্জন্ম নেবেন কিনা এই বাংলায়? আজ মহানায়কের মহাপ্রয়াণ দিবস! ছোট্ট দীপ্র কি বুঝেছে, সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। আমি স্পষ্টতই দেখলাম ওর চোখ ঝেঁপে বৃষ্টি। আমাকে বলছিল মামনি- ওঁ কি আর ফিরবে না!

১৯৬৪ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা যখন তুঙ্গে তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। প্রথম দিকে রাজ্জাক তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে “ঘরোয়া” নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হন। মঞ্চের সঙ্গে জড়িত থাকলেও স্বপ্ন ছিল সিনেমাকে ঘিরে। টালিগঞ্জের সিনেমা শিল্পে তখন ছবি বিশ্বাস, উত্তম কুমার, সৌমিত্র, বিশ্বজিতদের যুগ। সেখানে হালকা-পাতলা সাধারণ রাজুর অভিনয় সুযোগ পাবার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। এর মধ্যে শুরু হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এক সময় কলকাতায় থাকাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে। ঐ সময় এক সুহৃদ রাজ্জাককে পরামর্শ দিলেন ঢাকায় চলে আসতে। ঢাকার চলচ্চিত্র নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে।

রাজ্জাক ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা আবদুল জব্বার খানের পরিচিতি পান। জব্বার খানের সহায়তায় ইকবাল ফিল্মস লিমিটেড-এ কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান আব্দুর রাজ্জাক। সহকারী পরিচালকের কাজ। কামাল আহমেদের সহকারী পরিচালক হিসেবে তিনি প্রথম কাজ করেন ‘উজালা’ ছবিতে। শুরু হলো ঢাকায় রাজ্জাকের চলচ্চিত্র জীবন। জহির রায়হানের সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় অসাধারণ লক্ষ্মীন্দর হয়ে দর্শকদের সামনে উপস্থিত হলেন। সঙ্গে অপূর্ব সুন্দরী বেহুলারূপী সুচন্দা। ১৯৬৬ সালে মুক্তি পেল ‘বেহুলা’। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন একজন নায়ক, যিনি পরবর্তী সময়ে এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের অপরিহার্য নায়কে পরিণত হলেন।

১৯৭৮ সালে রাজ্জাক যখন অবিশ্বাস্য জনপ্রিয় এক অভিনেতা। ওই সময় আজিজুর রহমানের ‘অশিক্ষিত’ ছবিতে দর্শকরা তাঁকে দেখলেন গ্রামের এক পাহারাদারের চরিত্রে। লুঙ্গি আর চার পকেটওয়ালা শার্ট পরে পুরো ছবিতে রাজ্জাক যা করলেন তখনকার সিনেমাপ্রেমী দর্শকরা কি তা আজও ভুলতে পেরেছে? ছবির শেষ দৃশ্যে মাস্টার সুমনের মৃত্যুর পর পুলিশের খাতায় রাজ্জাকের স্বাক্ষর করার দৃশ্যটি দেখলে আজও সবার চোখে পানি আসে। এর দুই বছর পর একই পরিচালক আজিজুর রহমানের ‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবিতে স্কুলের দপ্তরির চরিত্রে রাজ্জাকের অসাধারণ অভিনয় কি মন থেকে মুছে ফেলা সম্ভব? বড় কথা ওই সময় যে অবস্থানে থেকে রাজ্জাক পাহারাদার কিংবা স্কুলের দপ্তরির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সেটা আজকের কোনো জনপ্রিয় নায়কের কাছ থেকে আশা করা যায়? আবার দিলীপ বিশ্বাসের ‘জিঞ্জির’, মতিন রহমানের ‘অন্ধ বিশ্বাস’ ছবির দুর্দান্ত দাপুটে অভিনেতার গুণ এখনকার ক’জন নায়কের মাঝে খুঁজে পাওয়া যাবে? সবচেয়ে বড় কথা, রাজ্জাক খুব ভালো করে জানতেন কখন কী করতে হবে। নিজের পরিচালিত ‘বদনাম’ ছবিতে নায়ক জাফর ইকবালকে দিয়ে সবচেয়ে হিট গান ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো’ গাইয়ে ছবির সাফল্যটা আদায় করে নিয়েছিলেন। কোন কাজ কখন কোন সময়ে কাকে দিয়ে করাতে হবে এটা ভালোভাবে জানেন বলেই চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার সময়ে নিজের প্রযোজনা-পরিচালনায় ‘বাবা কেন চাকর’ বানিয়ে চলচ্চিত্রের চেহারাটাই বদলে দিয়েছিলেন। এই ছবি দ্বিতীয়বার কলকাতায় চালিয়েও সাফল্য নিয়ে এসেছেন। রাজ্জাক আপদমস্তক চলচ্চিত্রের মানুষ তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে তিনি তার দুই পুত্র বাপ্পারাজ এবং সম্রাটকে নিয়ে এক সঙ্গে অভিনয় করেছেন ‘কোটি টাকার ফকির’ ছবিতে। দুই ছেলেকে নিয়ে অভিনয় করাটাকেই রাজ্জাক তাঁর জীবনের সেরা প্রাপ্তি হিসেবে মনে করতেন।



৮০’র দশকে ভীষণ জনপ্রিয় হওয়া সপরিবারে রাজ্জাকের ভিউকার্ডটি কিছুদিন আগে ফেসবুকে তাঁর ছোট ছেলে চলচ্চিত্র নায়ক সম্রাটের প্রোফাইলে দেখেছিলাম। বারবার ঘুরে ফিরে একটা কথাই মাথায় আসছিল- বর্তমান তথাকথিত নায়কেরা যখন বৌ-বাচ্চা বছরের পর বছর লুকিয়ে রাখে। ক্যারিয়ারের মিথ্যে অজুহাতে বৌ-বাচ্চা অস্বীকার করে নিজে নায়ক বনে যাওয়ার বৃথা চেষ্টা করে। অথচ, প্রায় তিন দশক আগে সপরিবারে তোলা ছবি জনসম্মুখে প্রকাশ করেন সুপার হিট অভিনেতা পাঁচ সন্তানের জনক নায়ক রাজ রাজ্জাক। কারন তিনি জানতেন, প্রতিভাবান-সৎ কর্মই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। কলকাতায় মুসলিম ঘরে জন্ম নেয়ায় টালিগঞ্জের বাংলা সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে প্রচন্ডভাবে হন উপেক্ষিত হোন তিনি, সেখানে সবকিছুতেই হিন্দুদের প্রাধান্য দেয়া হতো। উল্লেখ্য, সেসময়ে খ্যাতির প্রত্যাশায় জন্মগত মুসলিম নাম ঢেকে দিয়ে, মোহাম্মদ ইউসুফ খান হিন্দু নাম দীলিপ কুমার ধারণ করলেও সে পথে হাঁটেননি রাজ্জাক। তিনি চলে এসেছিলেন ঢাকা ফিল্মে। অতঃপর রাজত্ব করেছেন সদর্পে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম মুক্তি পায় রাজ্জাক অভিনীত ছবি ‘মানুষের মন’। মোস্তফা মেহমুদ পরিচালিত এই ছবির ব্যবসায়িক সাফল্যে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নতুনভাবে জেগে উঠে। সেই সঙ্গে শুরু হয় নায়ক রাজ্জাকের যুগ। সেরা প্রাপ্তি পেলেন ইউনিসেফের শুভেচ্ছা দূত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ষাটের দশকের বাকি বছরগুলোতে এবং সত্তরের দশকেও তাঁকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রধান অভিনেতা হিসেবে বিবেচনা করা হত। উর্দু এবং বাংলা মিলে প্রায় ৩০০টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। সালাউদ্দিন প্রোডাকশন্সের (প্রযোজনায়) 'তেরো নাম্বার ফেকু অস্তাগড় লেন' চলচ্চিত্রে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করে সবার কাছে নিজ মেধার পরিচয় দেন রাজ্জাক। পরবর্তীতে 'কার বউ', 'ডাক বাবু', 'আখেরী স্টেশন'সহ আরও বেশ ক’টি ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করে ফেলেন। পরে বেহুলা চলচ্চিত্রে তিনি নায়ক হিসেবে হিসেবে ঢালিউডে উপস্থিত হন স্বকীয় অভিনয় দাপটেl পরিচালনা করেছেন প্রায় ১৬টি চলচ্চিত্র। নায়করাজ পেয়েছেন অসংখ্য জাতীয় চলচ্চিত্র ও বাচসাস পুরস্কার। কিছুদিন আগে পেয়েছেন দুই বাংলার চলচ্চিত্র জগতে বিশেষ অবদানের জন্য আজীবন সম্মাননা। কলকাতার নজরুল মঞ্চে আয়োজিত ১৬তম টেলিসিনে অ্যাওয়ার্ডে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত হন তিনি।

২১ আগস্ট সন্ধ্যায় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে জীবনবসান হয় এই কিংবদন্তীর (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি স্ত্রী খায়রুন্নেছা লক্ষী, তিন ছেলে বাপ্পারাজ, বাপ্পি ও সম্রাট এবং দুই মেয়ে শম্পা ও ময়নাকে রেখে গেছেন।

জীবন্ত রাজ্জাক শুন্য ঢাকাই চলচ্চিত্র। রাজ্জাকের মৃত্যু যেন বাংলা সিনেমার একটি যুগের অবসান হলো।

এ ক্ষতি অপূরণীয়।



(বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ার আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত তথ্যসূত্র)