01-02-2018, 04:34 PM
ছোবল
Written by:Tanjina Akter Tania(হিমাদ্রির মেঘ)
..
অামার পিচ্চি মামনিটা ইদানিং ভারি দুষ্ট হয়ে
গেছে।সবকিছুই ঠিকঠাক মত করে শুধু স্কুলে যেতে
চায়না।স্কুলে যাওয়ার জন্য বললেই নাদুস নুদুস গাল
দুটো ফুলিয়ে ভূতোম প্যাঁচা হয়ে যায় একেবারে।আর
চোখ বেয়ে অনর্গল পানি পড়।মেয়েটা একেবারে
আমার মতন হয়েছে।ছোটবেলায় আমিও স্কুলে যেতে
চাইতাম না।মা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠাতেন।এত
বছর পর আল্লাহ আমাকেও এমন একটা মেয়ে
দিয়েছেন মনে হয় এই ভেবেই যে আমি যেন কিছুটা
হলেও বুঝতে পারি যে বাচ্চারা স্কুলে না গেলে
মায়েদের কতটা ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
.
আমার মেয়েটার বয়স আট বছর।এবার ক্লাস থ্রিতে
পড়ে।এতদিন স্কুলে যেতে ও কোন আপত্তি করতোনা।
কিন্তু এই থ্রিতে উঠার পর থেকেই ও আর স্কুলে
যেতে চাচ্ছেনা।আবার পড়ায় খুব মনযোগ ওর।কেবল
স্কুলে যেতে বললেই যত সমস্যা।ওর বাবাই ওর জন্য
প্রতিদিন কোন আইসক্রিম নিয়ে আসে আর বলে যে
স্কুলে যাওয়ার সময় আইসক্রিমটা দেবে আর স্কুলে
না গেলে দেবেনা।কোন আইসক্রিম ওর অনেক প্রিয়।
ওর কথা হচ্ছে যে ওর আইসক্রিম লাগবেনা তবু ও
স্কুলে যাবেনা।এই মেয়টা স্কুল কামাই করায়
আমাকেও এক ধাপ ছাড়িয়ে গেছে।যা হোক বাচ্চা
মানুষ।হয়তো বয়সের তুলনায় পড়াশুনার চাপটা একটু
বেশী পড়ে গেছে ওর উপর তাই এমন করে।ওকে
বুঝিয়ে শুনিয়ে আদর
দিয়েই বশ করতে হবে।ওর সবচেয়ে দুর্বল জায়গা
হচ্ছে ওর বাবাই।বাবাই ছাড়া মেয়েটা আমার কিছুই
বোঝেনা।আমার থেকেও সে তার বাবাকে বেশী
ভালবাসে।ওর ভাষ্যমতে ওর বাবাই হচ্ছে পৃথিবীর সব
থেকে ভাল বাবাই।বাবাই বাসায় না থাকলে
আমাকে একেবারে অস্থির করে ফেলে তাথৈ
(আমার মেয়ের নাম)একটু পর পর সে বাবাইয়ের সাথে
ফোনে কথা বলতে চাইবে।এই যে কত করে বোঝাই
যে বাবাই ব্যস্ত থাকে অফিসে।বার বার ফোন
দিলে সে বিরক্ত বোধ করতে পারে।কিন্তু না।সে
কিছুতেই এই কথা শুনতে রাজী না।সে বলে, বাবাই
বলেছে আমার যতবার বাবাইয়ের সাথে কথা বলতে
মন চাইবে আমি যেন ততবারই ফোন দেই।পরক্ষনই
আবার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষজনের মত কোমড়ে হাত
দিয়ে বলবে
-আমি হচ্ছি বাবাইয়ের মা।কেন আম্মু তুমি কি শুননা
যে,বাবাই আমাকে ছোট আম্মু বলে ডাকে।মা ফোন
করলে কি ছেলে বিরক্তবোধ করতে পারে?
.
আমি আমার মেয়ের মুখের পাকা পাকা কথা শুনে
মুখ টিপে হাসি।এই বয়সেই বড্ড বেশী পেকে
গিয়েছে ও।ওর বাবাকে বলে ও একটা চশমা আনিয়ে
নিয়েছে।বড় বড় ছেলেদের মায়েদের নাকি চশমা
পড়তে হয়।নাহলে নাকি মায়ের মত লাগেনা।ও
সাড়াদিন এমন সব আজব আজব কথা বলেনা যে
নিজেই হতবাক হয়ে বসে থাকি।
.
তাথৈ এর বাবাই রাতে বসে টিভি দেখছিল।ও দৌড়ে
এসে বাবাইয়ের
কোলে এসে বসলো।ও কোলে বসতেই সাইফ(আমার
হাজব্যান্ড) চমকে উঠে বললো
-মামনি তুমি ঘুমাওনি?
-বাবাই,তুমি আজ বাসায় ফিরে আমার কপালে চুম
খাওনি কেন?
সাইফ এবার জিভে কামড় বসালো।মেয়ে যে তাকে
আজ আচ্ছামত ধোলাই দিবে সেটা সে বোঝতে
পেরে গিয়েছে।আমতা আমতা করে বললো
-ইয়ে না মানে,আমি ভেবেছিলাম তুমি ঘুমিয়ে
গিয়েছ।
-আমি ঘুমিয়ে গেলে বুঝি তুমি আমাকে চুম দিতে
পারনা?আসলে তুমি আমাকে একটুও ভালবাস না।সব
দেখানো ভালবাসা।
আমি আলুভর্তা মাখাতে মাখাতে আড়চোখে বাপ
বেটীর কান্ড দেখে মুখ টিপে হাসছিলাম।
.
সাইফ এবার মেয়ের মুখটা দুহাতে তোলে ধরে বললো
-ছিঃ মা।এভাবে বলেনা।আমি তোমাকে এত্তগুলো
ভালবাসি।তুমিনা আমার মা হও।আমিকি তোমার
থেকে বেশী ভাল আর কাউকে বাসতে পার।
তাথৈ এবার অভিমানী মুড নিয়ে বললো
-হুম পারো।তুমি আম্মুকে আমার থেকে বেশী
ভালবাস।কারন তুমি আম্মুকে ঘুমের মধ্যেও কপালে
চুম খাও।
.
এবার শুধু সাইফ না সাথে আমিও লজ্জা পেয়ে
গেলাম।সাইফ বোকার মত আমার দিকে আর আমি
সাইফের দিকে তাকালাম।
.
সকাল বেলায় সাইফ তাথৈকে পড়াচ্ছে।প্রতিদিন
সকালে সাইফ ওকে পড়ায় আর আমি কিচেনে রান্না
করি।রাতের বেলায় আমি পড়াই তাথৈকে।সাইফ
ওকে পড়াচ্ছে ঠিকই কিন্তু ওর পড়ায় মন বসছেনা।ও
কেবল বার বার
ফ্রিজ থেকে কোন আইসক্রিম বের করে দিতে
বলছে।সাইফ না পেরে ওকে ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম
বের করে দিল।
যেহেতু ও আইসক্রিম খেয়ে ফেলেছে তাই আজ তার
স্কুলে না গেলেও চলবে।কেননা এই আইসক্রিমের
লোভ দেখিয়েই ওকে স্কুলে পাঠানো হয়।কোন কোন
দিন অবশ্য আইসক্রিমেও কাজ হয়না।বলে যে
আইসক্রিম লাগবেনা ওর তবুও স্কুলে যাবেনা।
.
যেহেতু আইসক্রিম আজ খেয়ে ফেলেছে তাই আজ
আর সে স্কুলে যাবেনা বলে বায়না ধরেছে।আমি
আর ওর বাবাই অনেক বলে কয়ে ওকে রাজী করালাম
স্কুলে যেতে।তবে ও একটা শর্ত জুরে দিল স্কুলে
যেতে।যদি ওর বাবাই ওকে আজ স্কুলে নিয়ে যায়
আবার স্কুল থেকে নিয়ে আসে তবেই সে স্কুলে
যাবে।ওর ফ্রেন্ডসদের বাবারা নাকি মাঝে মাঝে
তাদের স্কুলে দিয়ে যায় কিন্তু ওকে রোজ কেন ওর
আম্মুই নিয়ে যাবে!আজ বাবাইকে ওকে স্কুলে নিয়ে
যেতে হবে। এই যে ওর বাবাই ওকে বুঝালো যে
তাকে স্কুলে ছাড়তে গেলে তার বাবার অফিস
যেতে লেট হয়ে যাবে তবু সে শুনলো না।
.
সাইফ অতঃপর মেয়ের জেদের কাছে হার মানলো।
সে তাথৈকে স্কুলে দিয়ে আসলো আবার নিয়েও
আসলো।
.
আমি দরজা খুলে বাপ বেটীকে দেখেতো রীতিমত
টাস্কি খেয়ে গেলাম।দুজনের গায়েই নোংড়া
কাঁদাপানির দাগ। সাইফ খুব হাসছে কিন্তু কিছু
বলছেনা।শুধু বললো
-তোমার মেয়েকে
জিজ্ঞাসা কর।আমি তাথৈকে কিছু জিজ্ঞাসা
করার আগেই তাথৈ বলে বসলো
-জানো আম্মু!বাবাই যখন আমাকে স্কুলে আনতে গেল
তখন বাবাইয়ের গায়ে কাঁদাপানি লেগে ছিল।
আজতো প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে।ড্রেনের পানি আর
বৃষ্টির পানিতে রাস্তা ভর্তি হয়ে গিয়েছে।
বাবাইয়ের নাকি আমার স্কুলে যাওয়ার সময় শরীরে
কাঁদাপানি লেগেছে।বাবাইয়ের গায়ে কাঁদাপানি
লাগায় বাবাই রিক্সাতে উঠে আমাকে দূরে বসিয়ে
রেখেছিল।কিছুতেই বাবাইয়ের সাথে মিশতে
দিচ্ছিল না।তাই আমি রিক্সাওয়ালা আংকেলকে
রিক্সা থামাতে বললাম আর উনি রিক্সা থামাতেই
আমি রাস্তায় নেমে গায়ে কাঁদাপানি লাগিয়ে
নিলাম যাতে করে আমি বাবাইয়ের সাথে মিশে
বসতে পারি।বাবাইয়ের থেকে দূরে বসতে আমার
ভাল লাগছিল না।
.
মেয়ের কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।এতটুকু
মেয়ের মাথায় কি বুদ্ধি আর ওর বাবাইয়ের জন্য ওর
মনে কি পরিমান ভালবাসা!
.
রাতে শুয়ার সময় তাথৈ বায়না করবে ও বাবাই আর
আম্মুর মাঝে শুবে আর ও যতক্ষন সজাগ থাকবে ততক্ষন
আমাদের ওর সাথে কথা বলতে হবে।
ঘুমের ঘোরে যখন তাথৈ তার ছোট ছোট হাত পা
আমার পেটের উপর তুলে রাখে তখন ভীষন ভাল
লাগে আমার।মেয়েটা মাঝে মাঝে আমাকে আর ওর
বাবাকে একসাথে বসিয়ে মুখে তোলে খাইয়ে দেয়।
আমি আর সাইফ ব্যাপারটা খুব উপভোগ
করি।আগে ওর বাবার টাই আমি বেঁধে দিতাম এখন
তাথৈ আমাকে সেটা করতে দেয়না।ও চেয়ারে
দাড়িয়ে ওর ছোট ছোট হাত দিয়ে ওর বাবার গলায়
টাই বেঁধে দেয়।আমাকে তাগেদা দিয়ে ওর
বাবাইয়ের শার্ট প্যান্ট ধোঁয়ায়,ইস্ত্রি করায় তারপর
ওর বাবাই অফিস যাওয়ার সময় ওগুলো নিজ হাতে
খাটের উপর এনে রাখে।ওর বাবা অফিসে যাবার
সময় একবার ওকে কপালে চুম দিয়ে যায় আরেকবার
অফিস থেকে এসে চুম খায়।কোনদিন যদি এই রুটিন
মিস হয়ে যায় তবেই ওর বাবাইর খবর আছে।
.
অামার তাথৈ মাকে নিয়ে ভালই কাটছিল
অামাদের দিন শুধু স্কুলে যাওয়া নিয়েই ছিল ওর যত
প্রবলেম।অাজ সকালে ওর বাবাই রাগ করেতো ওর
গালে একটা থাপ্পরই বসিয়ে দিল।অামিতো নিজের
চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না।যে মেয়ে
ওর এত প্রিয় সেই মেয়েকে কি করে ও মারতে
পারলো!এ নিয়ে ওর সাথে খুব ঝগড়া করলাম।
.
সেদিন রাতে ও বাসায় ফিরলো একটু দেরী করে।
এসে দেখে তাথৈ ঘুমিয়ে পড়েছে।তাথৈকে জড়িয়ে
ধরে ও খুব কান্না করছিল।বোধ হয় মেয়েকে সকালে
মারার জন্য ওর সারাটা দিন খুব খারাপ কেটেছে।
বড্ড অাদরের মেয়েতো।মেয়েটা অাজ অামার
ড্রয়িং করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে।ও এই বয়সেই
অনেক ভাল অার্ট করে।অামি ওর ড্রয়িং খাতা অার
পেন্সিলগুলো গুছাতে গেলাম ওমনি একটা অদ্ভুদ
অার্ট দেখে অামার চোখ অাটকে গেল ঐটাতে।
অামি বিস্ময় অার ভয়ার্ত চোখ নিয়ে অার্টটার
দিকে তাকালাম।সেখানে একটা পুরুষ মানুষের ছবি
অাঁকা যার জিভটে কিছুটা বের করা অার তার
সামনে পিচ্চি একটা মেয়ে।লোকটা মেয়েটার
জামার চেইনে হাত দিচ্ছে।লোকটার পাশে তাথৈ
লিখেছে এটা সুবীর স্যার।উনি একজন পঁচা লোক।
অার পিচ্চি মেয়েটার পাশে লিখা এটা তাথৈ।
তাথৈ একটা লক্ষী মেয়ে।অার্টটা দেখে অামার
অকাশ মাটি যেন এক হয়ে গেল।স্তব্দ হয়ে গেলাম
অামি।অামার চোখের সামনে একবার ভেসে উঠতে
লাগলো অামার মেয়ের মিষ্টি হাসি অারেকবার ঐ
শিক্ষকের কালো লোমশ হাত।চোখ দুটো অামার
পানিতে ভরে উঠলো অার বুকটা ভয়ে ধুক ধুক করে
উঠলো।এই জন্যই তাহলে অামার মেয়ে এখন স্কুলে
যেতে চায়না?
.
না এর একটে বিহীত করতেই হবে।নিজেকে বড়
অপরাধী মনে হচ্ছে অাজ।অামার মেয়ের সাথে
অামার অারও ফ্রিলি সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার
ছিল।মেয়েকে ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞাসা করা
উচিত ছিল কেন ও স্কুলে যেতে চায়না।মেয়ের এই
শোচনীয় অবস্থার জন্য নিজেদেরই দায়ী মনে হচ্ছে।
যাহোক যা হবার হয়েছে।এর একটা এস্পার ওস্পার
করতেই হবে।ঐ শিক্ষককে উপযুক্ত শাস্তি না দিলে
অারও অনেক লোভাতুর দৃষ্টির ছোবলে পড়তে হবে
এরকম অারও অনেক তাথৈকে।
Written by:Tanjina Akter Tania(হিমাদ্রির মেঘ)
..
অামার পিচ্চি মামনিটা ইদানিং ভারি দুষ্ট হয়ে
গেছে।সবকিছুই ঠিকঠাক মত করে শুধু স্কুলে যেতে
চায়না।স্কুলে যাওয়ার জন্য বললেই নাদুস নুদুস গাল
দুটো ফুলিয়ে ভূতোম প্যাঁচা হয়ে যায় একেবারে।আর
চোখ বেয়ে অনর্গল পানি পড়।মেয়েটা একেবারে
আমার মতন হয়েছে।ছোটবেলায় আমিও স্কুলে যেতে
চাইতাম না।মা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠাতেন।এত
বছর পর আল্লাহ আমাকেও এমন একটা মেয়ে
দিয়েছেন মনে হয় এই ভেবেই যে আমি যেন কিছুটা
হলেও বুঝতে পারি যে বাচ্চারা স্কুলে না গেলে
মায়েদের কতটা ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
.
আমার মেয়েটার বয়স আট বছর।এবার ক্লাস থ্রিতে
পড়ে।এতদিন স্কুলে যেতে ও কোন আপত্তি করতোনা।
কিন্তু এই থ্রিতে উঠার পর থেকেই ও আর স্কুলে
যেতে চাচ্ছেনা।আবার পড়ায় খুব মনযোগ ওর।কেবল
স্কুলে যেতে বললেই যত সমস্যা।ওর বাবাই ওর জন্য
প্রতিদিন কোন আইসক্রিম নিয়ে আসে আর বলে যে
স্কুলে যাওয়ার সময় আইসক্রিমটা দেবে আর স্কুলে
না গেলে দেবেনা।কোন আইসক্রিম ওর অনেক প্রিয়।
ওর কথা হচ্ছে যে ওর আইসক্রিম লাগবেনা তবু ও
স্কুলে যাবেনা।এই মেয়টা স্কুল কামাই করায়
আমাকেও এক ধাপ ছাড়িয়ে গেছে।যা হোক বাচ্চা
মানুষ।হয়তো বয়সের তুলনায় পড়াশুনার চাপটা একটু
বেশী পড়ে গেছে ওর উপর তাই এমন করে।ওকে
বুঝিয়ে শুনিয়ে আদর
দিয়েই বশ করতে হবে।ওর সবচেয়ে দুর্বল জায়গা
হচ্ছে ওর বাবাই।বাবাই ছাড়া মেয়েটা আমার কিছুই
বোঝেনা।আমার থেকেও সে তার বাবাকে বেশী
ভালবাসে।ওর ভাষ্যমতে ওর বাবাই হচ্ছে পৃথিবীর সব
থেকে ভাল বাবাই।বাবাই বাসায় না থাকলে
আমাকে একেবারে অস্থির করে ফেলে তাথৈ
(আমার মেয়ের নাম)একটু পর পর সে বাবাইয়ের সাথে
ফোনে কথা বলতে চাইবে।এই যে কত করে বোঝাই
যে বাবাই ব্যস্ত থাকে অফিসে।বার বার ফোন
দিলে সে বিরক্ত বোধ করতে পারে।কিন্তু না।সে
কিছুতেই এই কথা শুনতে রাজী না।সে বলে, বাবাই
বলেছে আমার যতবার বাবাইয়ের সাথে কথা বলতে
মন চাইবে আমি যেন ততবারই ফোন দেই।পরক্ষনই
আবার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষজনের মত কোমড়ে হাত
দিয়ে বলবে
-আমি হচ্ছি বাবাইয়ের মা।কেন আম্মু তুমি কি শুননা
যে,বাবাই আমাকে ছোট আম্মু বলে ডাকে।মা ফোন
করলে কি ছেলে বিরক্তবোধ করতে পারে?
.
আমি আমার মেয়ের মুখের পাকা পাকা কথা শুনে
মুখ টিপে হাসি।এই বয়সেই বড্ড বেশী পেকে
গিয়েছে ও।ওর বাবাকে বলে ও একটা চশমা আনিয়ে
নিয়েছে।বড় বড় ছেলেদের মায়েদের নাকি চশমা
পড়তে হয়।নাহলে নাকি মায়ের মত লাগেনা।ও
সাড়াদিন এমন সব আজব আজব কথা বলেনা যে
নিজেই হতবাক হয়ে বসে থাকি।
.
তাথৈ এর বাবাই রাতে বসে টিভি দেখছিল।ও দৌড়ে
এসে বাবাইয়ের
কোলে এসে বসলো।ও কোলে বসতেই সাইফ(আমার
হাজব্যান্ড) চমকে উঠে বললো
-মামনি তুমি ঘুমাওনি?
-বাবাই,তুমি আজ বাসায় ফিরে আমার কপালে চুম
খাওনি কেন?
সাইফ এবার জিভে কামড় বসালো।মেয়ে যে তাকে
আজ আচ্ছামত ধোলাই দিবে সেটা সে বোঝতে
পেরে গিয়েছে।আমতা আমতা করে বললো
-ইয়ে না মানে,আমি ভেবেছিলাম তুমি ঘুমিয়ে
গিয়েছ।
-আমি ঘুমিয়ে গেলে বুঝি তুমি আমাকে চুম দিতে
পারনা?আসলে তুমি আমাকে একটুও ভালবাস না।সব
দেখানো ভালবাসা।
আমি আলুভর্তা মাখাতে মাখাতে আড়চোখে বাপ
বেটীর কান্ড দেখে মুখ টিপে হাসছিলাম।
.
সাইফ এবার মেয়ের মুখটা দুহাতে তোলে ধরে বললো
-ছিঃ মা।এভাবে বলেনা।আমি তোমাকে এত্তগুলো
ভালবাসি।তুমিনা আমার মা হও।আমিকি তোমার
থেকে বেশী ভাল আর কাউকে বাসতে পার।
তাথৈ এবার অভিমানী মুড নিয়ে বললো
-হুম পারো।তুমি আম্মুকে আমার থেকে বেশী
ভালবাস।কারন তুমি আম্মুকে ঘুমের মধ্যেও কপালে
চুম খাও।
.
এবার শুধু সাইফ না সাথে আমিও লজ্জা পেয়ে
গেলাম।সাইফ বোকার মত আমার দিকে আর আমি
সাইফের দিকে তাকালাম।
.
সকাল বেলায় সাইফ তাথৈকে পড়াচ্ছে।প্রতিদিন
সকালে সাইফ ওকে পড়ায় আর আমি কিচেনে রান্না
করি।রাতের বেলায় আমি পড়াই তাথৈকে।সাইফ
ওকে পড়াচ্ছে ঠিকই কিন্তু ওর পড়ায় মন বসছেনা।ও
কেবল বার বার
ফ্রিজ থেকে কোন আইসক্রিম বের করে দিতে
বলছে।সাইফ না পেরে ওকে ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম
বের করে দিল।
যেহেতু ও আইসক্রিম খেয়ে ফেলেছে তাই আজ তার
স্কুলে না গেলেও চলবে।কেননা এই আইসক্রিমের
লোভ দেখিয়েই ওকে স্কুলে পাঠানো হয়।কোন কোন
দিন অবশ্য আইসক্রিমেও কাজ হয়না।বলে যে
আইসক্রিম লাগবেনা ওর তবুও স্কুলে যাবেনা।
.
যেহেতু আইসক্রিম আজ খেয়ে ফেলেছে তাই আজ
আর সে স্কুলে যাবেনা বলে বায়না ধরেছে।আমি
আর ওর বাবাই অনেক বলে কয়ে ওকে রাজী করালাম
স্কুলে যেতে।তবে ও একটা শর্ত জুরে দিল স্কুলে
যেতে।যদি ওর বাবাই ওকে আজ স্কুলে নিয়ে যায়
আবার স্কুল থেকে নিয়ে আসে তবেই সে স্কুলে
যাবে।ওর ফ্রেন্ডসদের বাবারা নাকি মাঝে মাঝে
তাদের স্কুলে দিয়ে যায় কিন্তু ওকে রোজ কেন ওর
আম্মুই নিয়ে যাবে!আজ বাবাইকে ওকে স্কুলে নিয়ে
যেতে হবে। এই যে ওর বাবাই ওকে বুঝালো যে
তাকে স্কুলে ছাড়তে গেলে তার বাবার অফিস
যেতে লেট হয়ে যাবে তবু সে শুনলো না।
.
সাইফ অতঃপর মেয়ের জেদের কাছে হার মানলো।
সে তাথৈকে স্কুলে দিয়ে আসলো আবার নিয়েও
আসলো।
.
আমি দরজা খুলে বাপ বেটীকে দেখেতো রীতিমত
টাস্কি খেয়ে গেলাম।দুজনের গায়েই নোংড়া
কাঁদাপানির দাগ। সাইফ খুব হাসছে কিন্তু কিছু
বলছেনা।শুধু বললো
-তোমার মেয়েকে
জিজ্ঞাসা কর।আমি তাথৈকে কিছু জিজ্ঞাসা
করার আগেই তাথৈ বলে বসলো
-জানো আম্মু!বাবাই যখন আমাকে স্কুলে আনতে গেল
তখন বাবাইয়ের গায়ে কাঁদাপানি লেগে ছিল।
আজতো প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে।ড্রেনের পানি আর
বৃষ্টির পানিতে রাস্তা ভর্তি হয়ে গিয়েছে।
বাবাইয়ের নাকি আমার স্কুলে যাওয়ার সময় শরীরে
কাঁদাপানি লেগেছে।বাবাইয়ের গায়ে কাঁদাপানি
লাগায় বাবাই রিক্সাতে উঠে আমাকে দূরে বসিয়ে
রেখেছিল।কিছুতেই বাবাইয়ের সাথে মিশতে
দিচ্ছিল না।তাই আমি রিক্সাওয়ালা আংকেলকে
রিক্সা থামাতে বললাম আর উনি রিক্সা থামাতেই
আমি রাস্তায় নেমে গায়ে কাঁদাপানি লাগিয়ে
নিলাম যাতে করে আমি বাবাইয়ের সাথে মিশে
বসতে পারি।বাবাইয়ের থেকে দূরে বসতে আমার
ভাল লাগছিল না।
.
মেয়ের কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।এতটুকু
মেয়ের মাথায় কি বুদ্ধি আর ওর বাবাইয়ের জন্য ওর
মনে কি পরিমান ভালবাসা!
.
রাতে শুয়ার সময় তাথৈ বায়না করবে ও বাবাই আর
আম্মুর মাঝে শুবে আর ও যতক্ষন সজাগ থাকবে ততক্ষন
আমাদের ওর সাথে কথা বলতে হবে।
ঘুমের ঘোরে যখন তাথৈ তার ছোট ছোট হাত পা
আমার পেটের উপর তুলে রাখে তখন ভীষন ভাল
লাগে আমার।মেয়েটা মাঝে মাঝে আমাকে আর ওর
বাবাকে একসাথে বসিয়ে মুখে তোলে খাইয়ে দেয়।
আমি আর সাইফ ব্যাপারটা খুব উপভোগ
করি।আগে ওর বাবার টাই আমি বেঁধে দিতাম এখন
তাথৈ আমাকে সেটা করতে দেয়না।ও চেয়ারে
দাড়িয়ে ওর ছোট ছোট হাত দিয়ে ওর বাবার গলায়
টাই বেঁধে দেয়।আমাকে তাগেদা দিয়ে ওর
বাবাইয়ের শার্ট প্যান্ট ধোঁয়ায়,ইস্ত্রি করায় তারপর
ওর বাবাই অফিস যাওয়ার সময় ওগুলো নিজ হাতে
খাটের উপর এনে রাখে।ওর বাবা অফিসে যাবার
সময় একবার ওকে কপালে চুম দিয়ে যায় আরেকবার
অফিস থেকে এসে চুম খায়।কোনদিন যদি এই রুটিন
মিস হয়ে যায় তবেই ওর বাবাইর খবর আছে।
.
অামার তাথৈ মাকে নিয়ে ভালই কাটছিল
অামাদের দিন শুধু স্কুলে যাওয়া নিয়েই ছিল ওর যত
প্রবলেম।অাজ সকালে ওর বাবাই রাগ করেতো ওর
গালে একটা থাপ্পরই বসিয়ে দিল।অামিতো নিজের
চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না।যে মেয়ে
ওর এত প্রিয় সেই মেয়েকে কি করে ও মারতে
পারলো!এ নিয়ে ওর সাথে খুব ঝগড়া করলাম।
.
সেদিন রাতে ও বাসায় ফিরলো একটু দেরী করে।
এসে দেখে তাথৈ ঘুমিয়ে পড়েছে।তাথৈকে জড়িয়ে
ধরে ও খুব কান্না করছিল।বোধ হয় মেয়েকে সকালে
মারার জন্য ওর সারাটা দিন খুব খারাপ কেটেছে।
বড্ড অাদরের মেয়েতো।মেয়েটা অাজ অামার
ড্রয়িং করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে।ও এই বয়সেই
অনেক ভাল অার্ট করে।অামি ওর ড্রয়িং খাতা অার
পেন্সিলগুলো গুছাতে গেলাম ওমনি একটা অদ্ভুদ
অার্ট দেখে অামার চোখ অাটকে গেল ঐটাতে।
অামি বিস্ময় অার ভয়ার্ত চোখ নিয়ে অার্টটার
দিকে তাকালাম।সেখানে একটা পুরুষ মানুষের ছবি
অাঁকা যার জিভটে কিছুটা বের করা অার তার
সামনে পিচ্চি একটা মেয়ে।লোকটা মেয়েটার
জামার চেইনে হাত দিচ্ছে।লোকটার পাশে তাথৈ
লিখেছে এটা সুবীর স্যার।উনি একজন পঁচা লোক।
অার পিচ্চি মেয়েটার পাশে লিখা এটা তাথৈ।
তাথৈ একটা লক্ষী মেয়ে।অার্টটা দেখে অামার
অকাশ মাটি যেন এক হয়ে গেল।স্তব্দ হয়ে গেলাম
অামি।অামার চোখের সামনে একবার ভেসে উঠতে
লাগলো অামার মেয়ের মিষ্টি হাসি অারেকবার ঐ
শিক্ষকের কালো লোমশ হাত।চোখ দুটো অামার
পানিতে ভরে উঠলো অার বুকটা ভয়ে ধুক ধুক করে
উঠলো।এই জন্যই তাহলে অামার মেয়ে এখন স্কুলে
যেতে চায়না?
.
না এর একটে বিহীত করতেই হবে।নিজেকে বড়
অপরাধী মনে হচ্ছে অাজ।অামার মেয়ের সাথে
অামার অারও ফ্রিলি সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার
ছিল।মেয়েকে ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞাসা করা
উচিত ছিল কেন ও স্কুলে যেতে চায়না।মেয়ের এই
শোচনীয় অবস্থার জন্য নিজেদেরই দায়ী মনে হচ্ছে।
যাহোক যা হবার হয়েছে।এর একটা এস্পার ওস্পার
করতেই হবে।ঐ শিক্ষককে উপযুক্ত শাস্তি না দিলে
অারও অনেক লোভাতুর দৃষ্টির ছোবলে পড়তে হবে
এরকম অারও অনেক তাথৈকে।