01-17-2017, 07:11 PM
"আতঙ্কের রাত"
ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
---------------------
সেদিন সকাল থেকেই মুষলধারায় বৃষ্টি
হচ্ছিল। পথঘাট জলে ডুবে গিয়েছিল
একেবারে। যানবাহন চলাচল বিপর্যস্ত
হয়ে পড়েছিল। অফিস কামাই করে
ঘরে বসে ছিলাম! হঠাৎ সন্ধেবেলা
অবনী এসে হাজির। ওর চুল
উসকোখুসকো। চোখ দুটো লাল।
কতদিন দাড়ি কামায়নি। বললাম, “কী ব্যাপার
রে?”
অবনী একটি কথাও না বলে আমার ঘরে
ঢুকে সোফায় গা এলিয়ে চুপচাপ বসে
রইল। অবনী আমার বন্ধু ও একজন
প্রেস ফোটোগ্রাফার। বিভিন্ন
কাগজে ওর তোলা ফোটো ছাপা হয়।
খুব স্মার্ট ও সুদর্শন যুবক।
ত্রিবেণীতে গঙ্গার ধারে ওদের
নিজেদের বাড়ি। সেখানেই থাকে এবং
ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে।
অবনীর ওইরকম চেহারা দেখে
বললাম, “তোর কী হয়েছে
অবনী? এ কী চেহারা তোর!”
অবনী তার করুণ চোখ দুটি তুলে
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি বোধ
হয় বেশিদিন বাঁচব না রে!”
“কেন, হঠাৎ এরকম মনে হওয়ার
মানে ?"
অবনী বলল, “তুই ভূত বিশ্বাস করিস?”
“না। তবে ভূতের নামে ভয় পাই। কিন্তু
চাক্ষুষ দেখিনি বলে বিশ্বাস করি না।”
“বাড়িতে আমি একদম টিকতে পারছি না।
আজ কিছুদিন হল আমার ঘরে অদ্ভুত সব
কাণ্ড হয়ে যাচ্ছে। আমার এত ভয়
করছে যে, মনে হচ্ছে আমি
আত্মহত্যা করি।”
ওর কথায় শিউরে উঠলাম আমি। বললাম, “ছিঃ
অবনী, ও-কথা মুখেই আনতে নেই।
কাপুরুষের মতো আত্মহত্যা করতে
যাবি কেন?”
অবনী হঠাৎ বলল, “আচ্ছা, আমি পাগল
হয়ে যাইনি তো?”
আমি বললাম, “মনে হচ্ছে তাই হয়েছিস।
যাক তোর ভাই কী করছে?”
“সে মাস দুই হল দুর্গাপুরে চাকরি
পেয়ে চলে গেছে।”
“তুই তা হলে বাড়িতে একা?”
“হ্যাঁ। কিন্তু বিশ্বাস কর, আজ কিছুদিন হল ও
বাড়িতে আমি কিছুতেই থাকতে পারছি না।
আমার বড় ভয় করছে। ওখানে আমি প্রতি
রাতে আর একজনের অস্তিত্ব অনুভব
করছি।”
“কে সে!”
“তা জানি না। তবে সে যে অশরীরী
তা আমি বুঝতে পারি।”
আমি নিজেই তখন স্টোভে জল গরম
করে চা বসালাম। তারপর দুবন্ধুতে চা
খেয়ে একটু আয়েস করে গুছিয়ে
বসলাম।
অবনী বলল, “আমি ভাবছি কিছুদিন তোর
এখানে থাকব। তোর কোনও
অসুবিধে হবে না তো?”
“না না, অসুবিধে হবে কেন? তবে
আমার মনে হয় তোর আমার কাছে
থাকার চেয়ে আমারই বরং তোর ওখানে
থাকা ভাল।”
“খবরদার। ওখানে কোনও মানুষ থাকতে
পারে না। তুইও পারবি না। আমার মতো
তুইও তা হলে পাগল হয়ে যাবি। আমি ভাবছি
ও বাড়িটা বিক্রি করে অন্য কোথাও
চলে যাব।”
“তোর ভাই আপত্তি করবে না?”
“বোধ হয় না। ওকে সব কথা জানিয়ে
চিঠি দিয়েছি। সামনের মাসে ও সোজা
তোর এখানে চলে আসবে। তারপর
এইখানে বসে আলোচনার পর যা হয়
একটা কিছু ঠিক করে নেব।”
“ও বাড়িতে তোরা কতদিন আছিস ?”
“ওটা তো আমাদের পৈতৃক বাড়ি। আমার বা
আমার ভাইয়ের জন্মই ও বাড়িতে।”
“এর আগে আর কখনও ওরকম অস্তিত্ব
অনুভব করেছিস ?”
“না, কখনও না। এমনকী দিন পনেরো
আগেও না।”
আমি কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলাম।
তারপর বললাম, “ঠিক কী কী হয় বল
তো?”
অবনী একবার হাতের ঘড়িটা দেখল।
তারপর বলল, “তুই যখন নিজেই যেতে
চাইছিস তখন আমার মনে হয় আমার কথা না
শুনে সবকিছু তোর নিজের চোখেই
দেখা বা অনুভব করা ভাল। কেননা আমার
সব কথা তুই বিশ্বাস করবি কিনা তা তো জানি
না। তবে তুই গেলে আমি খুব খুশি হব।
কেননা আমিও দেখতে চাই আমার ঘরে
আর একজনের উপস্থিতি সত্ত্বেও
ওইসব ঘটে কিনা। যদি যাস তো এখুনি চল।
লাস্ট ট্রেনটা পেয়ে যাব তা হলে।”
আমি বললাম, “না। আজ এই দুর্যোগের
রাতে নয়। কাল সকালে বরং যাব। তারপর দু-
একদিন থেকে আবার তোকে
সঙ্গে নিয়েই ফিরে আসব। যতদিন
তোর ভাই না আসে ততদিন তুই আমার
কাছেই থাকবি। এ অবস্থায় তোকে একা
থাকতে দেওয়া ঠিক হবে না।”
অবনী বলল, “তা হলে খুব ভাল হয় রে!
আমার এখন মাথার ঠিক নেই। আমার ভাল-
মন্দর ভার এখন তোর হাতেই ছেড়ে
দিলাম। তবে এও জেনে রাখিস, আমি
আর কোনওদিনই একা থাকতে পারব না।
সবসময়ের জন্য আমার একজন সঙ্গী
অবশ্যই চাই।”
এরপর আমরা দুজনে অনেক রাত
পর্যন্ত গল্প করে কাটালাম। আলুভাজা
আর গরম লুচি খেয়ে পাশাপাশি শুয়ে
পড়লাম দু’জনে। শোওয়ার পরেই ঘুম
ঘুম যখন ভাঙল তখন বেশ সকাল হয়ে
গেছে।
ঘুম থেকে উঠে অবনী বলল, “ওঃ,
কতদিন যে এমন আরামে ঘুমোইনি।
আমার তো একদম ইচ্ছে করছে না ওই
অভিশপ্ত বাড়িতে ফিরে যেতে।"
আমি বাথরুমে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে এসে
বললাম, “তোর ওখানে যাওয়ার গাড়ি
কখন?”
“সেই বেলা একটায়।”
“সে কী। সারাদিনে আর গাড়ি নেই?”
“না। একটা ছিল সকালে, সেটা এতক্ষণে
ছেড়ে গেছে।”
তা যাক। বেলা একটার গাড়িই সই। দুপুরে
খেয়েদেয়ে দু'জনে হাওড়া
স্টেশনে এলাম। তারপর বারহারোয়া
প্যাসেঞ্জারে তিনটের মধ্যেই
ত্রিবেণী। সেখান থেকে রিকশায়
চেপে গঙ্গার ধারে ওদের বাড়িতে।
ছোট্ট দোতলা বাড়ি। অবনীর সঙ্গে
আমাকে আসতে দেখে আশপাশের
লোকেরা এবং দোকানদাররা চাপা গলায়
ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কী
যেন বলাবলি করতে লাগল। আমি তখনকার
মতো আড়চোখে সবকিছু দেখে
নিলাম। তারপর অবনীদের বাড়িতে
গিয়ে দোতলায় ওর শোওয়ার ঘরে
ঢুকলাম। ওর ল্যাবরেটরি নীচে।
একপাশে খোলা ছাদ। ওর ঘরের
ভেতর থেকে গঙ্গা দেখা যায়। ছাদ
থেকে শ্মশান।
অবনীর বাড়িতে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে চা-
পর্ব শেষ করলাম। তারপর বললাম,
“অবনী, আমি একবার আধঘণ্টার জন্য
বাইরে যাচ্ছি। তুই একা থাকতে পারবি
তো?”
অবনী বলল, “তা পারব। এখন দিনের
বেলায় তো কোনও ভয় নেই। যা কিছু
উপদ্রর রাত্রে। তুই কিন্তু বেশি দেরি
করিস না।”
“না রে বাবা, না। তোকে একা রেখে
আমি কখনও বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে
পারি?”
আমি অবনীদের বাড়ি থেকে
বেরোতেই পাশের বাড়ির একজন
বয়স্কা মহিলা আমাকে ডাকলেন, “বাবা
শোনো।” আমি কাছে গেলে
বললেন, “তুমি অবনীর কে হও?”
“আমি ওর বন্ধু হই। কেন বলুন তো?”
“তুমি এসেছ খুব ভালই হয়েছে। হঠাৎ
কী যে হল ছেলেটার। মাঝরাত্তির
হলেই চিৎকার করবে আর ঘরময়
ছুটোছুটি করবে। আমার মনে হচ্ছে
কেউ কিছু খাইয়ে দিয়ে মাথাটা খারাপ
করে দিয়েছে ওর। তুমি বাবা ওর
ভাইকে একটা খবর দাও। আর পারো
তো কোনও মানসিক রোগের
ডাক্তার দেখাও।”
“আমি সেইজন্যই এসেছি মা।”
“বেশ করেছ বাবা। বেশ করেছ।”
ভদ্রমহিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি
সেই দোকানগুলোর কাছে এলাম,
যেখানে একটু আগেই ওকে
দেখে সকলে ফিসফিস করে কীসব
বলাবলি করছিল। আমি তাদের কাছে গিয়ে
বললাম, “আচ্ছা আপনারা তো
অবনীকে চেনেন, আমার বন্ধু হয়।
একটু আগে আপনারা ওকে দেখে
কীসব যেন ফিসফিস করে বলছিলেন।
সেইজন্যই আমি আপনাদের কাছে
এসেছি। কী ব্যাপার বলুন তো?
আপনারা কি ওর মধ্যে কোনও ভাবান্তর
লক্ষ করেছেন? আমি কিন্তু ওকে
সম্পূর্ণ অপ্রকৃতিস্থ মনে করছি।”
দোকানের লোকেরা বলল, “হ্যাঁ।
আমরাও ওকে হঠাৎ এইরকম হয়ে
যেতে দেখছি এবং সবচেয়ে
আশ্চর্যের ব্যাপার কী জানেন? ও
প্রায় রাতেই চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে
যায়।”
এমন সময় ওদের ভেতর থেকে
একজন যুবক এগিয়ে এসে বলল, “দাদা,
আমি এক রাতের একটা ঘটনার কথা বলব?
শুনলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন।
ভাববেন মিথ্যে কথা বলছি। আমার কথা
এরা কেউ বিশ্বাস করে না। হাসে। ,মনে
করে আমি বোধ হয় বানিযে বলছি।”
“বেশ তো, শুনিই না কী ব্যাপার?”
“শুনন তবে সেদিন রাতে অবনীদা
যখন চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায়
তখন আমি আর ওর পাশের বাড়ির বিষ্টুদা
ছুটে যাই। কিন্তু গিয়ে যা দেখলাম তাতে
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।”
“কীরকম!”
অবনীদা নীচের দরজায় খিল দিয়ে
ওপরের ঘরের দরজাও বন্ধ করে
শোয়। সেদিন অবনীদার চিৎকার শুনে
আমি আর বিষ্টুদা ছুটে গিয়ে নীচের
দরজায় ধাক্কাধাব্ধি করতে থাকি। বেশ
কিছুক্ষণ ধাক্কা দেওয়ার পর দেখলাম
দরজার খিলটা কে যেন খুলে দিল।
আমরা তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে
উঠে গিয়ে ওপরের দরজায় ধাক্কা
দিলাম। অবনীদার সাড়া নেই। তারপর হঠাৎ
যেন জাদুমন্ত্রবলে ওপরের ঘরের
দরজাটাও খুলে গেল। আমরা ভেতরে
ঢুকে দেখলাম অবনীদা অজ্ঞান হয়ে
পড়ে আছে। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে
এই, যে বাড়িতে অবনীদা একা থাকে
সে বাড়ির বন্ধ খিল আমাদের
ধাক্কাধাক্কির পর খুলে দিল কে?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “ষ্ট্রেঞ্জ!”
যুবকটি বলল, “অথচ আমার বা বিষ্টুদার এই
কথা এখানকার কেউ বিশ্বাসই করতে চায়
না।”
আমি বললাম, “দেখুন, আপনার কথা কেউ
বিশ্বাস করুক আর না করুক, আমি করছি। তাই
বলছি, আজ রাত্রে আপনাদের ভেতর
থেকে একজনও যদি কেউ আমাদের
কাছে থাকেন তা হলে খুব ভাল হয়।
আজ রাত্রে আমি নিজের চোখে
দেখতে চাই এখানে কী হয় না হয়।”
কিন্তু না। আমার কথায় রাজি হল না কেউ।
সবাই বলল, “না দাদা। ও বাড়িতে রাত্রিবাস
কিছুতেই করছি না। বলা যায় না যদি সত্যিই
ভৌতিক ব্যাপার কিছু হয়, তা হলে কার
কোপ কার ঘাড়ে চাপে। তবে হ্যাঁ, যদি
সেরকম ভয়াবহ কিছু দেখেন তা হলে
চেঁচিয়ে ডাকবেন আমাদের। আমরা
একজন নয়, সবাই ছুটে যাব। আর পারেন
তো দরজার খিলটা খুলে রাখবেন।”
আমি আচ্ছা’ বলে চলে এলাম।
আমি যখন ফিরে এলাম তখন দেখি
অবনী ছাদের আলসের ধারে চুপচাপ
দাঁড়িয়ে আছে। আমি এসে বললাম,
“কী রে, একা থাকতে ভয় করেনি
তো?”
অবনী ঘাড় নেড়ে বলল, “না। তবে
মনে খুব একটা সাহসও পাচ্ছিলাম না। তাই
বদ্ধ ঘরে না থেকে খোলা ছাদে
এসে বসে আছি।”
“বেশ করেছিস। এখন চল দেখি গঙ্গার
ধার থেকে একটু বেড়িয়ে আসি।”
“কোথাও নয়। ওই দেখ, আকাশের
অবস্থা। এই নামল বলে!”
“তা হলে চল ঘরে বসে রাতের খাওয়াটা
তৈরি করা যাক।”
“কী খাবি বল?”
“স্রেফ ডিমের ঝোল আর গরম ভাত।”
আমরা দুজনে ঘরে ঢুকে স্টোভ
ধরিয়ে ভাত বসালাম। সন্ধে উত্তীর্ণ
হয়ে রাত্রি হল। ভাত হয়ে গেলে
ডিমসেদ্ধ বসাচ্ছি তেমন সময় শুরু হল
প্রবল বর্ষণ। সে কী প্রচণ্ড বৃষ্টি।
গতকালের রেকর্ড বৃষ্টিকেও যেন
হার মানায়।
এরই মধ্যে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“অন্যদিন কি এমন সময় উৎপাত আরম্ভ
হয়?”
“কোনও ঠিক নেই। কখনও সন্ধের
পর থেকেই হয়, কখনও মাঝরাতে।
অবশ্য তুই থাকার জন্য যদি না হয় তা হলে
আলাদা কথা।”
আমি নিজের মনেই নানারকম কল্পনা
করতে লাগলাম, এখানে কী ঘটে না
ঘটে তাই নিয়ে। অবনী এখনও পর্যন্ত
আমাকে কিছুই বলেনি।
রাত তখন দশটা। এ পর্যন্ত সময়টা বেশ
নিরুপদ্রবেই কাটল। আমি আর অবনী
একই তক্তাপোশে একই বিছানায়
দুজনে পাশাপাশি শুলাম। শুয়ে গল্প করছি,
এমন সময় হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে
গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে অবনী
আমার কাছ ঘেঁষে সরে এসে বলল,
“এইবার, এইবার সে আসবে। নিশ্চয়ই
আসবে।”
“কে? কে আসবে?”
অবনী চিৎকার করে উঠল, “ওই। ওই
তো সে। ওই দ্যাখ।"
আমি শুয়ে-শুয়েই জানলার দিকে তাকালাম।
দেখলাম জানলার ঘষা কাঁচে ফ্রক পরা
চোদ্দ-পনেরো বছরের একটি
কিশোরী মেয়ে এলোচুলে
ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি কঠিন গলায় বললাম, “কে তুমি!”
মেয়েটি নিরুত্তর।
এমন সময় ফুস করে একটা দেশলাই
জ্বালার শব্দ হল। তারপরই দেখা গেল
টেবিলের বাতিটা জ্বলছে। এ ঘরে
আমি আর অবনী ছাড়া আর কেউ তো
নেই। তা হলে কে জ্বালল এই বাতি?
কে? কে সেই অশরীরী ?
ততক্ষণে ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেছে।
আমরা দুজনেই ভয়ে কাঠ।
চারদিক নিস্তব্ধ। নিঝুম। অবনী যেন
নীল হয়ে গেছে।
আমার সারা শরীর ঘেমে উঠল।
এমন সময় দেখতে পেলাম একটা হাত
সেই বাতিটা তুলে নিল। নিয়ে দরজার কাছ
পর্যন্ত গেল। তারপর কোমল গলার
একটি ডাক শোনা গেল, “এসো।”
আমি অবনীকে বললাম, “আয় তো,
কোথায় নিয়ে যায় ও দেখি।”
অবনী বলল, “না না। খেপেছিস? ও
আমায় রোজ ওইভাবে ডাকে। আমি যাই
না।”
“আয়। আয় বলছি।”
“আমার বড় ভয় করছে।”
“ভয় কী? আজ তুই একা নয়। আমি তো
আছি সঙ্গে। আয়।”
আমি প্রায় জোর করেই ওর হাত ধরে
টেনে তুললাম। তারপর টর্চটা নিয়ে
দরজার দিকে এগোলাম। দরজার খিল
আপনা থেকেই খুলে দরজাটা দুহাট
হয়ে গেল।
আলো আমাদের পথ দেখিয়ে চলল।
সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামল আলোটা।
তারপর নীচের ঘরের দরজার কাছে
গেল। যে ঘরে অবনীর ল্যাবরেটরি
সেই ঘরের কাছে থামল আলোটা।
ঘরে তালা দেওয়া ছিল। তালাটা আপনিই
খুলে গেল।
আমরা দুজনেই ঘরে ঢুকলাম।
বাতিটা টেবিলের ওপর রেখে হাতটা
অদৃশ্য হয়ে গেল। আর কারও
অস্তিত্বও রইল না সেখানে।
আমি বললাম, "কী হল? কথা কও। কথা
কইছ না কেন? বলো তুমি কে?”
অবনী যেন পাথর।
আমারও হাত-পা অবশ হয়ে আসছে।
এমন সময় শুনতে পেলাম সেই
কিশোরীর কণ্ঠস্বর, “আমাকে কেন
এখানে নিয়ে এসেছ? আমাকে মুক্তি
দাও। আমাকে বন্দি করে রেখো না।
তোমাদের দুটি পায়ে পড়ি।”
আমি ভয়ে-ভয়েই বললাম, “কে তুমি!”
“আমি শ্যামা।”
“তুমি কোথায়? কে তোমাকে বন্দি
করে রেখেছে?”
“আমাকে দেখতে পাচ্ছ না? এই তো
আমি। আমি এখানে।”
কণ্ঠস্বর শুনে ঘরের কোণের
দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেই
কিশোরীর জোৎস্নার মতো হালকা
শরীর অন্ধকারে ফুটে উঠল। কী
করুণ তার মুখ। সে একটু একটু করে তার
ছায়া শরীর নিয়ে অবনীর টেবিলের
দিকে এগিয়ে গেল। তারপর ড্রয়ার
টেনে একটা খাম বের করে
টেবিলের ওপর রাখল। রেখেই আবার
মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
আমি টেবিলের কাছে এগিয়ে গিয়ে
খামটা খুলতেই তার ভেতরে এই
কিশোরীর একটি ফুল সাইজের
ফোটো দেখতে পেলাম।
ফোটোর দিকে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ
দেখলাম ফোটোর ছবির মুখটা
কীরকম যেন বিকৃত হয়ে যাচ্ছে।
ঠোঁট দুটো কাঁপছে। চোখ দুটো
ঠেলে বেরিয়ে আসছে।
উঃ, কী বীভৎস দৃশ্য! আরও দেখলাম
ছবির গলার ওপর একটা মোটা শক্ত দড়ির
দাগ ফুটে উঠছে ক্রমশ। এক সময়
ফোটোর ভেতর থেকে
মেয়েটি চিৎকার করে বলে উঠল,
“এখনও হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছ কী?
আমার কষ্ট হচ্ছে না বুঝি? আমি যে আর
সহ্য করতে পারছি না। তোমরা এখুনি
এটাকে নষ্ট করে দাও। ছিঁড়ে কুটি-কুটি
করে আগুনে পুড়িয়ে দাও।”
আমি বললাম, “তা হলেই কি তোমার মুক্তি
হবে ?”
“হ্যাঁ। চিরতরে মুক্তি পাব আমি। আমি যে
আমার অস্তিত্ব পৃথিবীতে কোথাও
এতটুকুও রেখে যেতে চাই না।”
“কিন্তু কেন চাও না ?”
“সে তোমাদের জানবার দরকার নেই।
শুধু জেনে রেখো, যাদের ওপর
অভিমান করে আমি আত্মহত্যা করতে
বাধ্য হয়েছি, তাদেরই দেওয়ালে ছবি
হয়ে আমি কিছুতেই থাকতে পারব না।”
আমি সঙ্গে-সঙ্গে ছবিটি ছিড়ে
দেশলাই জ্বেলে পুড়িয়ে ফেললাম।
অবনীকে বললাম, “এই ফোটো
তোর তোলা?”
“হ্যাঁ। বছর দুয়েক আগে তোলা।
চুঁচুড়ার হরিবাবুর মেয়ের ছবি ওটা। ওর
জন্মদিনে তুলেছিলাম। কিছুদিন আগে
হরিবাবু কাঁদতে কাঁদতে এসে আমার হাত
দুটি ধরে মেয়ের ছবিটি চাইলেন।
জানালেন, গত মাসে সামান্য একটু ভুল
বোঝাবুঝির ব্যাপার নিয়ে মেয়েটিকে
তিনি এবং তাঁর স্ত্রী খুব বকবকি করেন।
তারপরেই বিপর্যয়। মেয়েটি হঠাৎ গলায়
দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে।”
“কিন্তু বছর দুই আগে যে ছবি তোলা
হয়েছিল সে ছবি হরিবাবু এতদিন বাদে
নিতে এলেন কেন?”
“বছর দুই আগে ছবিটা আমি তুলেছিলাম
ঠিকই, তবে ছবি তোলার পর থেকে
হরিবাবু টাকা দেওয়ার ভয়ে আমার সঙ্গে
আর দেখা করেননি। আমিও ফোটোর
নেগেটিভ ওয়াশ করে রেখে
দিয়েছিলাম। এখন মেয়ের স্মৃতিরক্ষা
করবার জন্য হরিবাবু ডবল চার্জ দিয়ে ছবি
নিতে এসেছেন। সম্পূর্ণ টাকা দিয়েও
গেছেন। কিন্তু মুশকিল হল হরিবাবুর কাছ
থেকে টাকা নিয়ে নেগেটিভটা
কোথাও আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
অবশেষে অনেক খোঁজাখুঁজির পর
নেগেটিভ পেলাম। কিন্তু নেগেটিভ
থেকে এই ফোটাে তৈরি করতে
গিয়েই যত বিপত্তি। বারবার
নেগেটিভের ভেতর থেকে,
ফোটাের ভেতর থেকে মেয়েটি
আমায় শাসাতে থাকে। ভয় দেখায়।
সেজন্য নীচের ঘরে ঢোকাই
আজকাল আমি বন্ধ করে দিয়েছিলাম।”
“সেই নেগেটিভটা আছে?”
“আছে।”
“দেখি।”
অবনী নেগেটিভটা আমার হাতে
দিতেই আমি সেটাকেও অগ্নিদগ্ধ
করলাম। তারপর ধীরে ধীরে
টর্চের আলোয় পথ দেখে দরজা
বন্ধ করে ওপরে এলাম।
সারারাত ঘুম এল না। শুয়ে শুয়ে অনেক
গল্প করলাম দু'জনে। বৃষ্টির বেগও
কমল৷ ভোরবেলা চা করে খেলাম।
ভোরের আগে কারেন্টও এসে
গেল।
অবনীকে বললাম, “আজ একবার
সময়মতো হরিবাবুকে টাকাটা তুই ফেরত
দিয়ে আসবি। কেমন? বলবি,
নেগেটিভটা হারিয়ে গেছে।”
অবনী বলল, “নিশ্চয়ই।”
এর পরও অবনীর বাড়িতে আমি
দিনদশেক ছিলাম। কিন্তু না। সে রাতের
পর থেকে আর কোনও উপদ্রবই ও
বাড়িতে হয়নি। এখনও না।
(সমাপ্ত)
----------------
ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
---------------------
সেদিন সকাল থেকেই মুষলধারায় বৃষ্টি
হচ্ছিল। পথঘাট জলে ডুবে গিয়েছিল
একেবারে। যানবাহন চলাচল বিপর্যস্ত
হয়ে পড়েছিল। অফিস কামাই করে
ঘরে বসে ছিলাম! হঠাৎ সন্ধেবেলা
অবনী এসে হাজির। ওর চুল
উসকোখুসকো। চোখ দুটো লাল।
কতদিন দাড়ি কামায়নি। বললাম, “কী ব্যাপার
রে?”
অবনী একটি কথাও না বলে আমার ঘরে
ঢুকে সোফায় গা এলিয়ে চুপচাপ বসে
রইল। অবনী আমার বন্ধু ও একজন
প্রেস ফোটোগ্রাফার। বিভিন্ন
কাগজে ওর তোলা ফোটো ছাপা হয়।
খুব স্মার্ট ও সুদর্শন যুবক।
ত্রিবেণীতে গঙ্গার ধারে ওদের
নিজেদের বাড়ি। সেখানেই থাকে এবং
ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে।
অবনীর ওইরকম চেহারা দেখে
বললাম, “তোর কী হয়েছে
অবনী? এ কী চেহারা তোর!”
অবনী তার করুণ চোখ দুটি তুলে
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি বোধ
হয় বেশিদিন বাঁচব না রে!”
“কেন, হঠাৎ এরকম মনে হওয়ার
মানে ?"
অবনী বলল, “তুই ভূত বিশ্বাস করিস?”
“না। তবে ভূতের নামে ভয় পাই। কিন্তু
চাক্ষুষ দেখিনি বলে বিশ্বাস করি না।”
“বাড়িতে আমি একদম টিকতে পারছি না।
আজ কিছুদিন হল আমার ঘরে অদ্ভুত সব
কাণ্ড হয়ে যাচ্ছে। আমার এত ভয়
করছে যে, মনে হচ্ছে আমি
আত্মহত্যা করি।”
ওর কথায় শিউরে উঠলাম আমি। বললাম, “ছিঃ
অবনী, ও-কথা মুখেই আনতে নেই।
কাপুরুষের মতো আত্মহত্যা করতে
যাবি কেন?”
অবনী হঠাৎ বলল, “আচ্ছা, আমি পাগল
হয়ে যাইনি তো?”
আমি বললাম, “মনে হচ্ছে তাই হয়েছিস।
যাক তোর ভাই কী করছে?”
“সে মাস দুই হল দুর্গাপুরে চাকরি
পেয়ে চলে গেছে।”
“তুই তা হলে বাড়িতে একা?”
“হ্যাঁ। কিন্তু বিশ্বাস কর, আজ কিছুদিন হল ও
বাড়িতে আমি কিছুতেই থাকতে পারছি না।
আমার বড় ভয় করছে। ওখানে আমি প্রতি
রাতে আর একজনের অস্তিত্ব অনুভব
করছি।”
“কে সে!”
“তা জানি না। তবে সে যে অশরীরী
তা আমি বুঝতে পারি।”
আমি নিজেই তখন স্টোভে জল গরম
করে চা বসালাম। তারপর দুবন্ধুতে চা
খেয়ে একটু আয়েস করে গুছিয়ে
বসলাম।
অবনী বলল, “আমি ভাবছি কিছুদিন তোর
এখানে থাকব। তোর কোনও
অসুবিধে হবে না তো?”
“না না, অসুবিধে হবে কেন? তবে
আমার মনে হয় তোর আমার কাছে
থাকার চেয়ে আমারই বরং তোর ওখানে
থাকা ভাল।”
“খবরদার। ওখানে কোনও মানুষ থাকতে
পারে না। তুইও পারবি না। আমার মতো
তুইও তা হলে পাগল হয়ে যাবি। আমি ভাবছি
ও বাড়িটা বিক্রি করে অন্য কোথাও
চলে যাব।”
“তোর ভাই আপত্তি করবে না?”
“বোধ হয় না। ওকে সব কথা জানিয়ে
চিঠি দিয়েছি। সামনের মাসে ও সোজা
তোর এখানে চলে আসবে। তারপর
এইখানে বসে আলোচনার পর যা হয়
একটা কিছু ঠিক করে নেব।”
“ও বাড়িতে তোরা কতদিন আছিস ?”
“ওটা তো আমাদের পৈতৃক বাড়ি। আমার বা
আমার ভাইয়ের জন্মই ও বাড়িতে।”
“এর আগে আর কখনও ওরকম অস্তিত্ব
অনুভব করেছিস ?”
“না, কখনও না। এমনকী দিন পনেরো
আগেও না।”
আমি কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলাম।
তারপর বললাম, “ঠিক কী কী হয় বল
তো?”
অবনী একবার হাতের ঘড়িটা দেখল।
তারপর বলল, “তুই যখন নিজেই যেতে
চাইছিস তখন আমার মনে হয় আমার কথা না
শুনে সবকিছু তোর নিজের চোখেই
দেখা বা অনুভব করা ভাল। কেননা আমার
সব কথা তুই বিশ্বাস করবি কিনা তা তো জানি
না। তবে তুই গেলে আমি খুব খুশি হব।
কেননা আমিও দেখতে চাই আমার ঘরে
আর একজনের উপস্থিতি সত্ত্বেও
ওইসব ঘটে কিনা। যদি যাস তো এখুনি চল।
লাস্ট ট্রেনটা পেয়ে যাব তা হলে।”
আমি বললাম, “না। আজ এই দুর্যোগের
রাতে নয়। কাল সকালে বরং যাব। তারপর দু-
একদিন থেকে আবার তোকে
সঙ্গে নিয়েই ফিরে আসব। যতদিন
তোর ভাই না আসে ততদিন তুই আমার
কাছেই থাকবি। এ অবস্থায় তোকে একা
থাকতে দেওয়া ঠিক হবে না।”
অবনী বলল, “তা হলে খুব ভাল হয় রে!
আমার এখন মাথার ঠিক নেই। আমার ভাল-
মন্দর ভার এখন তোর হাতেই ছেড়ে
দিলাম। তবে এও জেনে রাখিস, আমি
আর কোনওদিনই একা থাকতে পারব না।
সবসময়ের জন্য আমার একজন সঙ্গী
অবশ্যই চাই।”
এরপর আমরা দুজনে অনেক রাত
পর্যন্ত গল্প করে কাটালাম। আলুভাজা
আর গরম লুচি খেয়ে পাশাপাশি শুয়ে
পড়লাম দু’জনে। শোওয়ার পরেই ঘুম
ঘুম যখন ভাঙল তখন বেশ সকাল হয়ে
গেছে।
ঘুম থেকে উঠে অবনী বলল, “ওঃ,
কতদিন যে এমন আরামে ঘুমোইনি।
আমার তো একদম ইচ্ছে করছে না ওই
অভিশপ্ত বাড়িতে ফিরে যেতে।"
আমি বাথরুমে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে এসে
বললাম, “তোর ওখানে যাওয়ার গাড়ি
কখন?”
“সেই বেলা একটায়।”
“সে কী। সারাদিনে আর গাড়ি নেই?”
“না। একটা ছিল সকালে, সেটা এতক্ষণে
ছেড়ে গেছে।”
তা যাক। বেলা একটার গাড়িই সই। দুপুরে
খেয়েদেয়ে দু'জনে হাওড়া
স্টেশনে এলাম। তারপর বারহারোয়া
প্যাসেঞ্জারে তিনটের মধ্যেই
ত্রিবেণী। সেখান থেকে রিকশায়
চেপে গঙ্গার ধারে ওদের বাড়িতে।
ছোট্ট দোতলা বাড়ি। অবনীর সঙ্গে
আমাকে আসতে দেখে আশপাশের
লোকেরা এবং দোকানদাররা চাপা গলায়
ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কী
যেন বলাবলি করতে লাগল। আমি তখনকার
মতো আড়চোখে সবকিছু দেখে
নিলাম। তারপর অবনীদের বাড়িতে
গিয়ে দোতলায় ওর শোওয়ার ঘরে
ঢুকলাম। ওর ল্যাবরেটরি নীচে।
একপাশে খোলা ছাদ। ওর ঘরের
ভেতর থেকে গঙ্গা দেখা যায়। ছাদ
থেকে শ্মশান।
অবনীর বাড়িতে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে চা-
পর্ব শেষ করলাম। তারপর বললাম,
“অবনী, আমি একবার আধঘণ্টার জন্য
বাইরে যাচ্ছি। তুই একা থাকতে পারবি
তো?”
অবনী বলল, “তা পারব। এখন দিনের
বেলায় তো কোনও ভয় নেই। যা কিছু
উপদ্রর রাত্রে। তুই কিন্তু বেশি দেরি
করিস না।”
“না রে বাবা, না। তোকে একা রেখে
আমি কখনও বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে
পারি?”
আমি অবনীদের বাড়ি থেকে
বেরোতেই পাশের বাড়ির একজন
বয়স্কা মহিলা আমাকে ডাকলেন, “বাবা
শোনো।” আমি কাছে গেলে
বললেন, “তুমি অবনীর কে হও?”
“আমি ওর বন্ধু হই। কেন বলুন তো?”
“তুমি এসেছ খুব ভালই হয়েছে। হঠাৎ
কী যে হল ছেলেটার। মাঝরাত্তির
হলেই চিৎকার করবে আর ঘরময়
ছুটোছুটি করবে। আমার মনে হচ্ছে
কেউ কিছু খাইয়ে দিয়ে মাথাটা খারাপ
করে দিয়েছে ওর। তুমি বাবা ওর
ভাইকে একটা খবর দাও। আর পারো
তো কোনও মানসিক রোগের
ডাক্তার দেখাও।”
“আমি সেইজন্যই এসেছি মা।”
“বেশ করেছ বাবা। বেশ করেছ।”
ভদ্রমহিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি
সেই দোকানগুলোর কাছে এলাম,
যেখানে একটু আগেই ওকে
দেখে সকলে ফিসফিস করে কীসব
বলাবলি করছিল। আমি তাদের কাছে গিয়ে
বললাম, “আচ্ছা আপনারা তো
অবনীকে চেনেন, আমার বন্ধু হয়।
একটু আগে আপনারা ওকে দেখে
কীসব যেন ফিসফিস করে বলছিলেন।
সেইজন্যই আমি আপনাদের কাছে
এসেছি। কী ব্যাপার বলুন তো?
আপনারা কি ওর মধ্যে কোনও ভাবান্তর
লক্ষ করেছেন? আমি কিন্তু ওকে
সম্পূর্ণ অপ্রকৃতিস্থ মনে করছি।”
দোকানের লোকেরা বলল, “হ্যাঁ।
আমরাও ওকে হঠাৎ এইরকম হয়ে
যেতে দেখছি এবং সবচেয়ে
আশ্চর্যের ব্যাপার কী জানেন? ও
প্রায় রাতেই চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে
যায়।”
এমন সময় ওদের ভেতর থেকে
একজন যুবক এগিয়ে এসে বলল, “দাদা,
আমি এক রাতের একটা ঘটনার কথা বলব?
শুনলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন।
ভাববেন মিথ্যে কথা বলছি। আমার কথা
এরা কেউ বিশ্বাস করে না। হাসে। ,মনে
করে আমি বোধ হয় বানিযে বলছি।”
“বেশ তো, শুনিই না কী ব্যাপার?”
“শুনন তবে সেদিন রাতে অবনীদা
যখন চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায়
তখন আমি আর ওর পাশের বাড়ির বিষ্টুদা
ছুটে যাই। কিন্তু গিয়ে যা দেখলাম তাতে
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।”
“কীরকম!”
অবনীদা নীচের দরজায় খিল দিয়ে
ওপরের ঘরের দরজাও বন্ধ করে
শোয়। সেদিন অবনীদার চিৎকার শুনে
আমি আর বিষ্টুদা ছুটে গিয়ে নীচের
দরজায় ধাক্কাধাব্ধি করতে থাকি। বেশ
কিছুক্ষণ ধাক্কা দেওয়ার পর দেখলাম
দরজার খিলটা কে যেন খুলে দিল।
আমরা তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে
উঠে গিয়ে ওপরের দরজায় ধাক্কা
দিলাম। অবনীদার সাড়া নেই। তারপর হঠাৎ
যেন জাদুমন্ত্রবলে ওপরের ঘরের
দরজাটাও খুলে গেল। আমরা ভেতরে
ঢুকে দেখলাম অবনীদা অজ্ঞান হয়ে
পড়ে আছে। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে
এই, যে বাড়িতে অবনীদা একা থাকে
সে বাড়ির বন্ধ খিল আমাদের
ধাক্কাধাক্কির পর খুলে দিল কে?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “ষ্ট্রেঞ্জ!”
যুবকটি বলল, “অথচ আমার বা বিষ্টুদার এই
কথা এখানকার কেউ বিশ্বাসই করতে চায়
না।”
আমি বললাম, “দেখুন, আপনার কথা কেউ
বিশ্বাস করুক আর না করুক, আমি করছি। তাই
বলছি, আজ রাত্রে আপনাদের ভেতর
থেকে একজনও যদি কেউ আমাদের
কাছে থাকেন তা হলে খুব ভাল হয়।
আজ রাত্রে আমি নিজের চোখে
দেখতে চাই এখানে কী হয় না হয়।”
কিন্তু না। আমার কথায় রাজি হল না কেউ।
সবাই বলল, “না দাদা। ও বাড়িতে রাত্রিবাস
কিছুতেই করছি না। বলা যায় না যদি সত্যিই
ভৌতিক ব্যাপার কিছু হয়, তা হলে কার
কোপ কার ঘাড়ে চাপে। তবে হ্যাঁ, যদি
সেরকম ভয়াবহ কিছু দেখেন তা হলে
চেঁচিয়ে ডাকবেন আমাদের। আমরা
একজন নয়, সবাই ছুটে যাব। আর পারেন
তো দরজার খিলটা খুলে রাখবেন।”
আমি আচ্ছা’ বলে চলে এলাম।
আমি যখন ফিরে এলাম তখন দেখি
অবনী ছাদের আলসের ধারে চুপচাপ
দাঁড়িয়ে আছে। আমি এসে বললাম,
“কী রে, একা থাকতে ভয় করেনি
তো?”
অবনী ঘাড় নেড়ে বলল, “না। তবে
মনে খুব একটা সাহসও পাচ্ছিলাম না। তাই
বদ্ধ ঘরে না থেকে খোলা ছাদে
এসে বসে আছি।”
“বেশ করেছিস। এখন চল দেখি গঙ্গার
ধার থেকে একটু বেড়িয়ে আসি।”
“কোথাও নয়। ওই দেখ, আকাশের
অবস্থা। এই নামল বলে!”
“তা হলে চল ঘরে বসে রাতের খাওয়াটা
তৈরি করা যাক।”
“কী খাবি বল?”
“স্রেফ ডিমের ঝোল আর গরম ভাত।”
আমরা দুজনে ঘরে ঢুকে স্টোভ
ধরিয়ে ভাত বসালাম। সন্ধে উত্তীর্ণ
হয়ে রাত্রি হল। ভাত হয়ে গেলে
ডিমসেদ্ধ বসাচ্ছি তেমন সময় শুরু হল
প্রবল বর্ষণ। সে কী প্রচণ্ড বৃষ্টি।
গতকালের রেকর্ড বৃষ্টিকেও যেন
হার মানায়।
এরই মধ্যে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“অন্যদিন কি এমন সময় উৎপাত আরম্ভ
হয়?”
“কোনও ঠিক নেই। কখনও সন্ধের
পর থেকেই হয়, কখনও মাঝরাতে।
অবশ্য তুই থাকার জন্য যদি না হয় তা হলে
আলাদা কথা।”
আমি নিজের মনেই নানারকম কল্পনা
করতে লাগলাম, এখানে কী ঘটে না
ঘটে তাই নিয়ে। অবনী এখনও পর্যন্ত
আমাকে কিছুই বলেনি।
রাত তখন দশটা। এ পর্যন্ত সময়টা বেশ
নিরুপদ্রবেই কাটল। আমি আর অবনী
একই তক্তাপোশে একই বিছানায়
দুজনে পাশাপাশি শুলাম। শুয়ে গল্প করছি,
এমন সময় হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে
গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে অবনী
আমার কাছ ঘেঁষে সরে এসে বলল,
“এইবার, এইবার সে আসবে। নিশ্চয়ই
আসবে।”
“কে? কে আসবে?”
অবনী চিৎকার করে উঠল, “ওই। ওই
তো সে। ওই দ্যাখ।"
আমি শুয়ে-শুয়েই জানলার দিকে তাকালাম।
দেখলাম জানলার ঘষা কাঁচে ফ্রক পরা
চোদ্দ-পনেরো বছরের একটি
কিশোরী মেয়ে এলোচুলে
ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি কঠিন গলায় বললাম, “কে তুমি!”
মেয়েটি নিরুত্তর।
এমন সময় ফুস করে একটা দেশলাই
জ্বালার শব্দ হল। তারপরই দেখা গেল
টেবিলের বাতিটা জ্বলছে। এ ঘরে
আমি আর অবনী ছাড়া আর কেউ তো
নেই। তা হলে কে জ্বালল এই বাতি?
কে? কে সেই অশরীরী ?
ততক্ষণে ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেছে।
আমরা দুজনেই ভয়ে কাঠ।
চারদিক নিস্তব্ধ। নিঝুম। অবনী যেন
নীল হয়ে গেছে।
আমার সারা শরীর ঘেমে উঠল।
এমন সময় দেখতে পেলাম একটা হাত
সেই বাতিটা তুলে নিল। নিয়ে দরজার কাছ
পর্যন্ত গেল। তারপর কোমল গলার
একটি ডাক শোনা গেল, “এসো।”
আমি অবনীকে বললাম, “আয় তো,
কোথায় নিয়ে যায় ও দেখি।”
অবনী বলল, “না না। খেপেছিস? ও
আমায় রোজ ওইভাবে ডাকে। আমি যাই
না।”
“আয়। আয় বলছি।”
“আমার বড় ভয় করছে।”
“ভয় কী? আজ তুই একা নয়। আমি তো
আছি সঙ্গে। আয়।”
আমি প্রায় জোর করেই ওর হাত ধরে
টেনে তুললাম। তারপর টর্চটা নিয়ে
দরজার দিকে এগোলাম। দরজার খিল
আপনা থেকেই খুলে দরজাটা দুহাট
হয়ে গেল।
আলো আমাদের পথ দেখিয়ে চলল।
সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামল আলোটা।
তারপর নীচের ঘরের দরজার কাছে
গেল। যে ঘরে অবনীর ল্যাবরেটরি
সেই ঘরের কাছে থামল আলোটা।
ঘরে তালা দেওয়া ছিল। তালাটা আপনিই
খুলে গেল।
আমরা দুজনেই ঘরে ঢুকলাম।
বাতিটা টেবিলের ওপর রেখে হাতটা
অদৃশ্য হয়ে গেল। আর কারও
অস্তিত্বও রইল না সেখানে।
আমি বললাম, "কী হল? কথা কও। কথা
কইছ না কেন? বলো তুমি কে?”
অবনী যেন পাথর।
আমারও হাত-পা অবশ হয়ে আসছে।
এমন সময় শুনতে পেলাম সেই
কিশোরীর কণ্ঠস্বর, “আমাকে কেন
এখানে নিয়ে এসেছ? আমাকে মুক্তি
দাও। আমাকে বন্দি করে রেখো না।
তোমাদের দুটি পায়ে পড়ি।”
আমি ভয়ে-ভয়েই বললাম, “কে তুমি!”
“আমি শ্যামা।”
“তুমি কোথায়? কে তোমাকে বন্দি
করে রেখেছে?”
“আমাকে দেখতে পাচ্ছ না? এই তো
আমি। আমি এখানে।”
কণ্ঠস্বর শুনে ঘরের কোণের
দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেই
কিশোরীর জোৎস্নার মতো হালকা
শরীর অন্ধকারে ফুটে উঠল। কী
করুণ তার মুখ। সে একটু একটু করে তার
ছায়া শরীর নিয়ে অবনীর টেবিলের
দিকে এগিয়ে গেল। তারপর ড্রয়ার
টেনে একটা খাম বের করে
টেবিলের ওপর রাখল। রেখেই আবার
মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
আমি টেবিলের কাছে এগিয়ে গিয়ে
খামটা খুলতেই তার ভেতরে এই
কিশোরীর একটি ফুল সাইজের
ফোটো দেখতে পেলাম।
ফোটোর দিকে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ
দেখলাম ফোটোর ছবির মুখটা
কীরকম যেন বিকৃত হয়ে যাচ্ছে।
ঠোঁট দুটো কাঁপছে। চোখ দুটো
ঠেলে বেরিয়ে আসছে।
উঃ, কী বীভৎস দৃশ্য! আরও দেখলাম
ছবির গলার ওপর একটা মোটা শক্ত দড়ির
দাগ ফুটে উঠছে ক্রমশ। এক সময়
ফোটোর ভেতর থেকে
মেয়েটি চিৎকার করে বলে উঠল,
“এখনও হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছ কী?
আমার কষ্ট হচ্ছে না বুঝি? আমি যে আর
সহ্য করতে পারছি না। তোমরা এখুনি
এটাকে নষ্ট করে দাও। ছিঁড়ে কুটি-কুটি
করে আগুনে পুড়িয়ে দাও।”
আমি বললাম, “তা হলেই কি তোমার মুক্তি
হবে ?”
“হ্যাঁ। চিরতরে মুক্তি পাব আমি। আমি যে
আমার অস্তিত্ব পৃথিবীতে কোথাও
এতটুকুও রেখে যেতে চাই না।”
“কিন্তু কেন চাও না ?”
“সে তোমাদের জানবার দরকার নেই।
শুধু জেনে রেখো, যাদের ওপর
অভিমান করে আমি আত্মহত্যা করতে
বাধ্য হয়েছি, তাদেরই দেওয়ালে ছবি
হয়ে আমি কিছুতেই থাকতে পারব না।”
আমি সঙ্গে-সঙ্গে ছবিটি ছিড়ে
দেশলাই জ্বেলে পুড়িয়ে ফেললাম।
অবনীকে বললাম, “এই ফোটো
তোর তোলা?”
“হ্যাঁ। বছর দুয়েক আগে তোলা।
চুঁচুড়ার হরিবাবুর মেয়ের ছবি ওটা। ওর
জন্মদিনে তুলেছিলাম। কিছুদিন আগে
হরিবাবু কাঁদতে কাঁদতে এসে আমার হাত
দুটি ধরে মেয়ের ছবিটি চাইলেন।
জানালেন, গত মাসে সামান্য একটু ভুল
বোঝাবুঝির ব্যাপার নিয়ে মেয়েটিকে
তিনি এবং তাঁর স্ত্রী খুব বকবকি করেন।
তারপরেই বিপর্যয়। মেয়েটি হঠাৎ গলায়
দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে।”
“কিন্তু বছর দুই আগে যে ছবি তোলা
হয়েছিল সে ছবি হরিবাবু এতদিন বাদে
নিতে এলেন কেন?”
“বছর দুই আগে ছবিটা আমি তুলেছিলাম
ঠিকই, তবে ছবি তোলার পর থেকে
হরিবাবু টাকা দেওয়ার ভয়ে আমার সঙ্গে
আর দেখা করেননি। আমিও ফোটোর
নেগেটিভ ওয়াশ করে রেখে
দিয়েছিলাম। এখন মেয়ের স্মৃতিরক্ষা
করবার জন্য হরিবাবু ডবল চার্জ দিয়ে ছবি
নিতে এসেছেন। সম্পূর্ণ টাকা দিয়েও
গেছেন। কিন্তু মুশকিল হল হরিবাবুর কাছ
থেকে টাকা নিয়ে নেগেটিভটা
কোথাও আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
অবশেষে অনেক খোঁজাখুঁজির পর
নেগেটিভ পেলাম। কিন্তু নেগেটিভ
থেকে এই ফোটাে তৈরি করতে
গিয়েই যত বিপত্তি। বারবার
নেগেটিভের ভেতর থেকে,
ফোটাের ভেতর থেকে মেয়েটি
আমায় শাসাতে থাকে। ভয় দেখায়।
সেজন্য নীচের ঘরে ঢোকাই
আজকাল আমি বন্ধ করে দিয়েছিলাম।”
“সেই নেগেটিভটা আছে?”
“আছে।”
“দেখি।”
অবনী নেগেটিভটা আমার হাতে
দিতেই আমি সেটাকেও অগ্নিদগ্ধ
করলাম। তারপর ধীরে ধীরে
টর্চের আলোয় পথ দেখে দরজা
বন্ধ করে ওপরে এলাম।
সারারাত ঘুম এল না। শুয়ে শুয়ে অনেক
গল্প করলাম দু'জনে। বৃষ্টির বেগও
কমল৷ ভোরবেলা চা করে খেলাম।
ভোরের আগে কারেন্টও এসে
গেল।
অবনীকে বললাম, “আজ একবার
সময়মতো হরিবাবুকে টাকাটা তুই ফেরত
দিয়ে আসবি। কেমন? বলবি,
নেগেটিভটা হারিয়ে গেছে।”
অবনী বলল, “নিশ্চয়ই।”
এর পরও অবনীর বাড়িতে আমি
দিনদশেক ছিলাম। কিন্তু না। সে রাতের
পর থেকে আর কোনও উপদ্রবই ও
বাড়িতে হয়নি। এখনও না।
(সমাপ্ত)
----------------