Forums.Likebd.Com

Full Version: গতকাল মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেল
You're currently viewing a stripped down version of our content. View the full version with proper formatting.
গতকাল রাতের মতো আজও মধ্যরাতে
ঘুম ভেঙে গেল তার। মনে হল তার
মুখের ওপর কে যেন ঝুঁকে আছে।
চোখ খুললেই জানালা গলে ঢোকা
স্ট্রিট লাইটের আলোয় মুখটা
দেখতে পাবে। তার শরীরজুড়ে
আতঙ্কের হিমস্রোত বয়ে যায় ।
চোখ বুজে থাকে সে। গতকাল
রাতের মতো আজও পারফিউমের
মৃদুগন্ধ পেল সে। আর চুড়ির রিনরিন
শব্দ । 'আফসানা' বলে কে যেন
কাকে মৃদুস্বরে ডাকল। কে যেন
হেসে উঠল। বাচ্চা মেয়ের কন্ঠস্বর।
কারা ওরা? এ বাড়িতে সে একাই থাকে ।
তার শরীর ভিজে যায়। তারপর কখন
ঘুমিয়ে পড়েছিল সে ... ঘরের বড়
জানালাটা গলে ঝলমলে রোদ
ঢুকেছে সকালবেলা। জানালার ওপাশে
নাড়কেল পাতারা কাঁপছিল ।
গতরাতের ভয়টা এই মুহূর্তে মিথ্যা মনে
হয় তার। সে আড়মোড়া ভাঙল।
অফিসের জন্য তৈরি হতে হবে।
বাথরুমে ঢোকার আগে ঘরগুলি একবার
ঘুরে ঘুরে দেখল। তিনরুমের বাড়ি।
প্রতিটি ঘরই ফাঁকা। একাই থাকে বলে
আসবাবপত্র নেই। শোওয়ার ঘরেও
বিছানা নেই। মেঝেতে একটা
তোষক ফেলে রেখেছে। আর
কটা প্লাস্টিকের চেয়ার। ছুটির দিনে
অফিসের দারোয়ান এসে ঘরদোর
পরিস্কার করে দিয়ে যায়। এ বাড়িতে
রান্নাবান্নার ব্যবস্থাও রাখেনি । সকালবেলা
অফিসে যাওয়ার পথে কোনও একটা
রেস্টুরেন্টে ঢুকে নাশতা সেরে
নেয়।
দুপুরে খাবার পিয়নকে দিয়ে আনিয়ে
অফিসে খেয়ে নেয়। অফিসের পর
সময় কাটানো মুশকিল। মফঃস্বল শহরের
রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে । তারপর রাত আটটা-
নটার দিকে কোনও রেস্টুরেন্টে
খেয়ে বাড়ি ফেরে। গোছল
সেরে, কাপড় বদলে, ঘর তালা দিয়ে
সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এল সে
। তার অফিস কাছেই। একটা মোড় আর
একটা রেলক্রসিং পেরিয়ে হেঁটে
যেতে মিনিট দশেকের মতো সময়
লাগে ... আজ রাতে ঘুম আসছিল না তার।
বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিল সে। রাত
যতই বাড়ছিল একটা ভয় ততই তাকে গ্রাস
করছিল । আর পিছল এক অনুভূতি টের
পাচ্ছিল সে । আজ রাতেও কি তার
মুখের ওপর ঝুঁকে কেউ চেয়ে
থাকবে? সেই পারফিউমের হালকা গন্ধ
পাবে? শুনতে পাবে চুড়ির রিনরিন শব্দ?
অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি।
জানালায় পর্দাটর্দা টাঙ্গানো হয়নি। জানালা
গলে জোছনার সাদা আলো এসে
পড়েছিল তার চোখেমুখে। ঘুমে
চোখ একবার লেগে এসেছিল। ঠিক
তখনই যেন পাশের ঘরে চুড়ির রিনরিন
আওয়াজ শুনতে পেল। তার
শরীরজুড়ে শিরশিরে এক অনুভূতি
ছড়িয়ে যায়। তবে আজ ভয়ের বদলে
রাগ হল তার। । বিছানা ছেড়ে উঠে
অন্ধকারেই পাশের ঘরে ঢুকে
আলো জ্বালাল। কেউ নেই। আমারই
মনের ভুল? ভীষণ রাগ হচ্ছিল তার। ঘড়ি
দেখল সে। প্রায় একটা বাজে । আজ
আর ঘুম আসবে না। ফতুয়া গায়ে দিয়ে
সিগারেট ধরিয়ে নীচে নেমে এল
সে ।কালই অফিসে বলবে বাড়ি বদলে
দিতে । রাতের বেলা নির্জন বাড়িতে
থাকতে নার্ভের ওপর চাপ পড়ছে।
মেইন গেটের সামনে এসে
সিগারেট ধরালো সে। চারধার নিঝঝুম
হয়ে আছে। আকাশভরা জোছনার
আলোয় ফাঁকা নির্জন রাস্তার অনেক দূর
চোখে পড়ে । দূরে রেললাইনের
দিক থেকে কুকুর ডাকছিল।
ল্যাম্পপোস্টের আলোতেও
জায়গাটা উজ্জ্বল। বাতাসে হাসনাহেনার
গন্ধ। ভয়টা কিছুটা কমল। একবার দোতলার
দিকে তাকাল সে । বারান্দায় গ্রিল নেই।
পুরনো দিনের বাড়ি বলেই । এই
মুহূর্তে দোতলার বারান্দার অন্ধকারে
জোনাক পোকা জ্বলছে, নিভছে।
এখন ওই বাড়িতে ঢোকার কথা ভাবতেই
গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠছে ...
গতমাসে সে যখন এই ছোট্ট মফঃস্বল
শহরটায় বদলী হয়ে এল, অফিস
থেকেই তখন এই বাড়িটা তাকে ঠিক
করে দেওয়া হয়েছিল। দোতলা দালানটি
বেশ পুরনো । এককালে হলদে রং
ছিল।
এখন বৃষ্টিবাদলে দেয়ালে ছাতা ধরে
গেছে। একতলায় কোন্ এক অষুধ
কোম্পানীর গুদাম। কার্নিসে ‘রিকো
ফার্মা’ নামে কালো রঙের একটা
সাইনবোর্ড টাঙানো। মাসখানেক প্রায়
হয়ে এল এ বাড়িতে আছে সে । এর
মধ্যে অষুধ কোম্পানীর কাউকে
দেখেনি। একতলার বারান্দাটি গ্রিল দিয়ে
ঘেরা। ডান পাশে একটা কালো রঙের
কালেপসআবল গেট। গেটটা সব সময়
বন্ধ দেখেছে সে । বাঁ পাশে
দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। বাড়ি ঘিরে শ্যাওলা
ধরা দেয়াল। দেয়াল ঘেঁষে নাড়কেল
গাছের সারি । মর্চে ধরা কালো রঙের
মেইন গেটটাও পুরনো। সারাক্ষণ
খোলাই থাকে। বাড়ির সামনে পিচ রাস্তা।
বাড়ির ঠিক উলটো দিকে পিচ রাস্তা
ঘেঁষে একটা পানা পুকুর।
তারপর ফাঁকা মাঠ। ও মাঠে ধোপারা কাপড়
শুকাতে দেয়। মাঠের পরে একটা
স্কুলের পিছন দিকের দেয়াল। সব
মিলিয়ে এ জায়গাটা ভারি নির্জন। আজকাল
মফঃস্বল শহর হলেও এরকম নির্জন স্থান
বিরল। ... সিগারেট টানতে- টানতে
নিজের সঙ্গে তর্ক করে সে ।
এসবই আমার মনের ভুল? আমি একটা
নির্জন বাড়িতে একা আছি বলে আমার
মনে এরকম ভয়ের অনুভূতি হয়?
ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে
সিগারেট টানে। এক ধরণের অস্বস্তি
ঘিরে থাকে তাকে। টুংটাং শব্দে খানিকটা
চমকে ফিরে তাকায় সে। একটা রিকশা
এসে গেটের সামনে থেমেছে ।
সে খানিকটা অবাক হল। এত রাতে কারা
এল? সিগারেট ছুড়ে ফেলে দিল সে।
একজন মাঝবয়েসি ভদ্রলোক রিকশা
থেকে নামলেন। ভদ্রলোকের
পরনে সাদা রঙের ফতুয়া, কালো
রঙের প্যান্ট। গায়ের রং কালো। মাথার
সামনের দিকে টাক। মুখে দাড়ি। রিকশায়
একজন মহিলা বসে আছেন । ভদ্রমহিলার
কোলে ছ- সাত বছরের ছোট একটি
মেয়ে। বেশ মায়াবী আর টলটলে
দেখতে।
মেয়েটির মাথায় বাচ্চাদের সাদা রঙের
শোলার হ্যাট। ভদ্রলোক ভাড়া
মেটালেন। তারপর ছোট
মেয়েটিকে কোলে তুলে
নীচে নামিয়ে নিলেন । মহিলা
ধীরেসুস্থে রিকশা থেকে নেমে
এলেন।
তিরিশ- পঁয়ত্রিশের মতো বয়স হবে
মহিলার। পরনে শাদা রঙের শাড়ি। কালো
ব্লাউজ। রিকশা টুংটাং শব্দ তুলে চলে যায়।
মহিলা তার দিকে তাকালেন। তারপর
এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
আপনি তো এ বাড়িতেই থাকেন, না?
বলে মহিলা আঁচল ঠিক করলেন। চুড়ির
রিনরিন শব্দ হল। হ্যাঁ। সে বলে।
পারফিউমের পরিচিত মৃদু গন্ধ পেল সে।
আশ্চর্য! মহিলা এবার জিজ্ঞেস
করলেন, দোতলায় তো আফসানার
থাকে, না? সে ভীষণ চমকে ওঠে।
বলে, না তো ... রুনু খালা! দোতলা
থেকে ছোট মেয়ের কন্ঠস্বর
শুনে সে চমকে ওঠে। ঘুরে
দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে জমে
গেল সে। বারান্দায় উজ্জ্বল আলো
জ্বলে আছে। রেলিংয়ে ছ-সাত
বছরের ছোট একটি মেয়ে ঝুঁকে
আছে। বেশ মায়াবী আর টলটলে
দেখতে। মাথায় বাচ্চাদের সাদা রঙের
শোলার হ্যাট। বাচ্চাটি তার দিকে তাকিয়ে
হাত নাড়ছে। আশ্চর্য! কে ওই
মেয়েটি ? টের পায় সে-তার
কন্ঠনালী শুকিয়ে গেছে। ভদ্রমহিলা
উঁচু গলায় বললেন, তোর মা আছে
রে আফসানা? হ্যাঁ। এই তো মা। ছোট
মেয়েটির পাশে এসে একজন মহিলা
দাঁড়িয়েছেন। মহিলার বয়স তিরিশ- পঁয়ত্রিশ
বছর হবে।
পরনে শাদা শাড়ি। বাতাসে আঁচল উড়ছিল
বলেই কালো ব্লাউজটা চোখে
পড়ল। মহিলা তার দিকে তাকিয়ে আছে।
সে প্রবল শীত টের পায়। মহিলার
পাশে একজন ভদ্রলোক এসে
দাঁড়ালেন । মাঝবয়েসি। গায়ের রং
কালো। পরনে সাদা রঙের ফতুয়া। মাথার
সামনের দিকে অনেকখানি টাক। মুখে
দাড়ি। কারা ওরা? আতঙ্কে হিম হয়ে
যেতে থাকে সে। ভদ্রমহিলা ছোট
মেয়েটিকে কোলে তুলে
নিলেন। তারপর ‌'চলো' বলে হাঁটতে
থাকেন। ভদ্রলোক ওদের পিছন পিছন
যেতে থাকেন । ওপরে দরজা
খোলার শব্দ হয় । তারপর সিঁড়িতে
আলো জ্বলে ওঠে। কারা যেন কথা
বলছে। ওরা সিঁড়ির কাছাকাছি পৌঁছে
গেছে। ছোট মেয়েটি পিছন ফিরে
তার দিকে চেয়ে আছে।
ভেজা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে
সে । তার পা দুটো ভীষণ ভারী
ঠেকছে। মাথার ভিতরে কুয়াশা। মাথার তালু
ভিজে যাচ্ছে ঘামে। শরীরজুড়ে
হিমস্রোত টের পায়। কারা ওরা? এক
অদম্য কৌতূহল আর বিস্ময় তাকে সিঁড়ির
কাছে পৌঁছে দেয় ... যেন কেউ
তাকে ইশারায় ডাকছিল ... তারপর
ঘোরের মধ্যে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে
উঠতে- উঠতে পারফিউমের মৃদু গন্ধ
পেল সে ...