01-17-2017, 08:01 PM
আমার নাম রহমান। জুয়েল রহমান। পেশায়
ডাক্তার। থাকি ঢাকায়। আমি ভূত বিশ্বাস করি না।
ভূত কেন আমিতো ঈশ্বরকেও বিশ্বাস
করিনা। যে সময় মানুষ চাঁদে যাচ্ছে,
মঙ্গলগ্রহ জয় করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ,
সেই যুগে আমি ভূত নামক মানুষ সৃষ্ট
একটা ভ্রান্ত ধারণাকে মনে ঠাঁই দিতে
পারিনা। আমার বন্ধুরা আমকে নাস্তিক
বলে। বলুক। আমার তাতে কিছু যায়
আসে না। আমি আমার বিশ্বাসে অটল।
কেউ টিটকারি দিয়ে আমকে আমার
বিশ্বাস থেকে একটুও নড়াতে
পারবেনা। আমি নাস্তিক। একজন নাস্তিক
মানুষ। 6 জুলাই, 2006। রাতে ডিনার করে
ইজিচেয়ারে বসে একটা বই পড়ছিলাম।
এসময় বিকট শব্দে বেজে উঠল আমার
পুরনো আমলের টেলিফোন
সেটটা। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে
শুনতে পেলাম আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু
আবিরের কন্ঠস্বর। কাজ করে করে
একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।
আবিরকে বলেছিলাম কক্সবাজারের
একটা টিকিট কনফার্ম করে রাখতে।
একারনেই ফোন করেছে ও।
পরশুদিন বিকাল 5 টায় ফ্লাইট। খুশি হয়ে
উঠল মনটা। যাক কয়েকটা দিনতো
অন্তত নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে পারব। 8,
জুলাই।
যথাসময়ে রওনা দিলাম আমি। চট্টগ্রাম
পৌঁছতে সন্ধ্যা 7টা বেজে গেল।
ট্যাক্সির খোঁজে এদিক ওদিক তাকাতেই
একটা ট্যাক্সি এসে আমার সামনে
দাঁড়ালো। ট্যাক্সির ড্রাইভারের বয়স
বড়জোর 26 কি 27 হবে। কক্সবাজার
যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করলাম। যাবে। উঠে
বসতেই ট্যাক্সি ছাড়ল ও কক্সবাজারের
উদ্দেশ্যে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ
বসে থাকলাম। কিন্তু কতক্ষণ আর চুপচাপ
বসে থাকা যায়? তাই ঠিক করলাম ড্রাইভার
ছেলেটার সাথেই আলাপ জমাবো।
“নাম কি তোমার?“ আলাপ জমানোর
প্রথম পদক্ষেপ হল প্রথমে
অন্যজনের নাম জিজ্ঞাসা করা, তাই নাম
দিয়েই আলাপ শুরু করলাম আমি। “জনি,“
একটু হেসে উত্তর দিল সে। ওর কাছ
থেকে জানলাম ও গ্রাজুয়েশন
করেছে। কিন্তু কোনও চাকরি না
পেয়ে শেষে ট্যাক্সি চালানো শুরু
করেছে। আলাপ করতে করতেই
চারদিকের অন্ধকারাচছন্ন দৃশ্য দেখতে
লাগলাম আমি। এক ঘন্টা হয়ে গেছে
প্রায়। সিটে হেলান দিয়ে ঝিমাতে
লাগলাম আমি। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনিতে উঠে
বসলাম। “কি ব্যাপার, জনি?“ জিজ্ঞাসা করলাম
আমি। “টায়ার পাংচার হয়ে গেছে, স্যার।
গাড়িতে এক্সট্রা কোন টায়ারও নাই,“
বিব্রত ভঙ্গিতে উত্তর দিল জনি।
“সেকি? এখন কি করব?“ কিছুটা রাগতো
স্বরে বললাম আমি। “একটা ফোন করা
লাগবে, স্যার“। “ ফোন এখানে
কোথায় পাব। নির্জন রাস্তা ছাড়া কোনও
বাড়িঘর বা দোকানপাটতো চোখে
পড়ছেনা।“ বললাম আমি। হঠাৎ একদিকে
আঙুল তুললো জনি “ঐ দেখেন স্যার
একটা বাড়ি“। ওর নির্দেশিত দিকে তাকালাম
আমি। সত্যিই তো একটা বাড়ি দেখা
যাচ্ছে। “জনি চলতো দেখি ওই বাড়িতে
টেলিফোন পাওয়া যায় কিনা?“ বললাম আমি।
বেশী দূরে না বাড়িটা। তবে আমদের
অবস্থান থেকে বাড়িটা পর্যন্ত ঘন
ঝোপঝারে ভরা। বাড়িটাতে পৌঁছে
চারদিকে তাকালাম দরজার খোঁজে।
পেয়েও গেলাম দরজাটা।
ডোরবেলের খোঁজ করলাম দরজার
আশেপাশে, কিন্তু পেলাম না। “চুলোয়
যাক ডোরবেল,“ বলে দরজায় নক
করল জনি। ভেতর থেকে কোনও
সাড়াশব্দ পেলাম না। এবার জোরে
জোরে দরজায় বাড়ি দিতে লাগল ও।
একটু পর ভিতর থেকে মৃদু পায়ের
আওয়াজ পেলাম। ভীত মুখে বয়স
তিরিশেক একজন মহিলা দরজা খুলে দিল।
সন্দেহ ভরা দৃষ্টি নিয়ে আমদের
দুজনকে দেখল। “কে আপনারা?“
ভীত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
আমি আমাদের সব সমস্যার কথা খুলে
বলতেই ভিতরে ডাকলেন আমাদের।
তারপর জনকে দেখিয়ে দিলেন
কোন ঘরে টেলিফোন আছে।
জন চলে গেল টেলিফোন করতে।
ভদ্রমহিলা আমাকে সোফায় বসতে
বললেন। বসে থেকে ঘরের
চারদিকে চোখ বুলাতে লাগলাম আমি।
দেয়ালে দেখলাম ঐ ভদ্রমহিলা এবং এক
ভদ্রলোকের ছবি। আমাকে ছবির
দিকে তাকাতে দেখে মহিলা নিজেই
বললেন “উনি আমার স্বামী, গত বছর
সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।” “ওহ! আমি
দুঃখিত।” উঁনাকে এই বিষয়ে আর কোন
প্রশ্ন করে বিব্রত করতে চাইলামনা। “
আপনারা বসুন, আমি চা নিয়ে আসি,”
আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে
উনি দ্রুত রান্নাঘরের দিকে চলে
গেলেন। জনি এখনও আসেনি। চুপচাপ
বসে আছি। এমন সময় সামনের ঘরের
দরজা খুলে গেল।
ভেতর থেকে বের হয়ে আসলো
একজন লোক। তাকে দেখেই
চমকে উঠলাম আমি। চট করে ছবির
দিকে তাকালাম, না কোনও সন্দেহ
নেই। ছবির ঐ ভদ্রলোক। ভদ্রলোক
আমাকে দেখে অবাক হলেন। “কে
আপনি, আমার বাসায় ঢুকলেন
কীভাবে?”এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস
করলেন তিনি। “আপনি,” ওনার প্রশ্নের
উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম,
“আপনি জীবিত আছেন? কিন্তু উনি যে
বললেন.........” “আমি জীবিত আছি
মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি,”
বিস্ময় ফুটে উঠল তার চেহারায়।
“আপনার স্ত্রী বললেন আপনি মারা
গেছেন,” বললাম আমি। রাগ ফুটে উঠল
তার চেহারায়,“ইয়ারকি করছেন আপনি
আমার সাথে? কি যাতা বলছেন আমার মৃতা
স্ত্রী সম্পর্কে?” “মৃতা স্ত্রী,”
বোমা ফাটল যেন আমার কানের
পাশে,“কি সব উল্টো পাল্টা কথা
বলছেন আপনি, আপনার স্ত্রী তো
বেঁচে আছেন। চা বানাতে গেছেন
আমাদের জন্য,“ চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।
“দেখুন যথেষ্ট হয়েছে,
একেতো বিনা অনুমতিতে আমার
বাড়িতে ঢুকেছেন, আবার আমার মৃতা
স্ত্রী সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলছেন।
আমি..........।” কথা শেষ করতে
পারলেননা উনি কারণ জনি এসে
দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। অবাক হয়ে
জনির দিকে তাকালেন তিনি। “তুমি কে,”
তার কন্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি “ কেউ কি
আমকে বলবে কি হচেছ এখনে?”
“দেখুন মিস্টার....... ,” “আমান, আমি আমান
চৌধুরি,” ধরিয়ে দিলেন তিনি। “ওকে,
মিস্টার আমান চৌধুরি, দেখুন আমদের
গাড়ির টায়ার আপনার বাড়ির সামনে এসে
পাংচার হয়ে যায়, আমরা আপনার দরজা নক
করতে আপনার স্ত্রী দরজা খুলে
দেয় আর আমকে এখানে বসায়ে
রেখে উনি চা বানাতে গেছেন, দয়া
করে রান্নাঘরে যেয়ে উনাকে
জিজ্ঞাসা করুন।”
“আমি জানিনা আপনি কি বলছেন, কিন্তু
আমার স্ত্রী গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায়
মারা গেছেন,” বললেন আমান চৌধুরি।
“What the hell you are talking about,”
প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, “আমরা একটু
আগে উনার সাথে কথা বলেছি, জনি তুমিই
বল।” “ আমি জানিনা আপনারা নেশা
করেছেন কিনা কিন্তু আমার স্ত্রী
গতবছরই মারা গেছে।” “Please trust
me, MR. Aman, আমরা দুজন একসাথে
ভুল দেখতে পারিনা।” “তাহলে আপনারা
নিশ্চয়ই ওর আত্মাকে দেখেছেন,”
রাগ সরে গিয়ে হাসি হাসি হয়ে উঠল তার
মুখটা। “আত্মা! কি বলছেন আপনি?” “ঠিকই
বলছি, কারণ এখন আমি ওর আত্মাকে
আপনাদের পিছনে দেখতে পাচ্ছি।”
পিছনে ঘুরেই চমকে গেলাম আমরা, ঐ
মহিলাই হাস্যজ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
“সরি মিস্টার..... , ওহ আপনার নামটাই তো
জানা হয়নি, যাইহোক আমি পলি চৌধুরী,
আমানের স্ত্রী।” হাসিমুখে বললেন
উনি। “ আমরা সত্যিই দুঃখিত মিস্টার.......”
জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে আমান চৌধুরি তাকালেন
আমার দিকে। “রহমান, আমি জুয়েল
রহমান।” নাম বললাম আমি। “ওকে, মিস্টার
জুয়েল রহমান, আমরা সত্যিই দুঃখিত, জাস্ট
একটু ফান করলাম আপনাদের সাথে।”
“ফান?” বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা
করলাম আমি।
“হ্যা, ফান। আসলে আমরা দুজন
লোকালয় থেকে অনেক দূরে থাকি।
দুজনের সংসার। জরুরী কাজ ছাড়া শহরে
যাওয়া হয় না খুব একটা। মানুষের সাথে খুব
বেশী মেশাও হয় না। একেবারে
রসকষহীন জীবনযাপন করি। তাই জানালা
দিয়ে আপনাদের আসতে দেখে
ভাবলাম একটু ফান করা যাক। তাই দুজনে
একটু ভূতের অভিনয় করলাম। যাইহোক
ভাই, কিছু মনে করেন না।” হাসলেন
আমান চৌধুরি। হাসলাম আমিও। এতক্ষণে সব
বুঝতে পারলাম। জনির মুখটা ভয়ে
ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল এইসব কাণ্ড
কারখানা দেখে। এবার সব কিছু বুঝতে
পেরে শান্ত হয়ে আমার পাশে এসে
বসল। মিসেস আমান আমাদের চা নাশতা
পরিবেশন করলেন। একটু পর দরজায়
শব্দ হল। মেকানিক এসে গেছে। দশ
মিনিটও লাগলনা টায়ার পাল্টাতে। মিস্টার এবং
মিসেস আমানকে বিদায় জানায়ে আমি
আর জনি আবার রওনা হলাম। ঘড়ির দিকে
তাকিয়ে দেখলাম সাড়ে দশটা বেজে
গেছে। “স্যার, খুব ভয় পেয়েছিলেন
বুঝি,” জনি জিজ্ঞেস করল। “ভয়?
হেসে উঠলাম আমি। “এই জুয়েল রহমান
কখনও ভয় পায়না, জনি।
আমি যদি পৃথিবীতে কিছু অবিশ্বাস করি তা
হল ভূত আর ঈশ্বর।” জনি অবাক হয়ে
আমার দিকে তাকাল। তাকাক। সবাই তাকায়।
আমার এতে কিছু যায় আসে না। “স্যার,
ভূতও আছে, ঈশ্বরও আছে। আপনি এটা
অস্বীকার করতে পারেননা।” জনির
কথার ধরন দেখে অবাক হলাম। “আচ্ছা?
তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে?
কীভাবে তুমি এত জোর গলায় বলছ
যে ভূত আছে?” হঠাৎ গাড়ি একটা
জোরে ঝাঁকি খেয়ে থেমে
গেল। আমার দিকে ঘুরলো জনি। ধ্বক
করে উঠল আমার
বুকটা। দেখলাম যেখানে জনির
চোখজোড়া ছিল সেখানে এখন শুধু
শুন্য কোটর ভয়ংকর ভাবে আমার দিকে
তাকিয়ে আছে। “আমি এত জোর দিয়ে
বলছি কারণ আমি নিজেই ভূত, স্যার।”
ঘড়ঘড়ে কন্ঠে বলল জনি। হঠাৎ
দেখলাম জনির চামড়া আস্তে আস্তে
খসে পরতে লাগল। ঠোঁট দুটো
খসে গিয়ে সেখানে উঁকি দিল ভয়ংকর
কাল দাঁতসহ কুৎসিত লাল মাড়ি।
পচা মাংসের তীব্র গন্ধে ভরে গেল
গাড়ির ভিতরটা। কিছুক্ষণ পরে ওর দেহে
আর মাংস বা চামড়া বলে কিছু থাকল না। শুধু
একটা ভয়ংকর কঙ্কাল বিদঘুটে ভাবে
আমার দিকে চেয়ে থাকল। অজান্তেই
তীব্র চিৎকার বেরিয়ে আসল আমার
গলা থেকে। কিন্তু এই নির্জন জায়গায়
আমার চিৎকার শোনার কেউ নাই। গাড়ির
দরজা খোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু
হাতদুটো যেন অসাড় হয়ে গেছে,
যেন কেউ সম্মোহিত করে
রেখেছে আমকে। আবার কুৎসিত
কঙ্কালটার দিকে তাকালাম। দেখলাম
ধীরে ধীরে ওটা একটা কুৎসিত হাত
বাড়িয়ে দিচ্ছে আমার দিকে। 9 জুলাই।
সন্ধ্যা 7 টা বাজছে প্রায়। আমি চট্টগ্রাম
এয়ারপোর্টের সামনে ট্যাক্সির ভিতর
বসে আছি। অপেক্ষা করছি একজন
প্যাসেঞ্জারের জন্য। শুধু আমি না
আমার মত আরও অনেক ভূত অপেক্ষা
করছে ট্যাক্সি নিয়ে।
একজন প্যাসেঞ্জার পেলেই তাকে
নিয়ে রওয়ানা হয়ে যাব। চট্টগ্রাম
হাইওয়ে থেকে বেশ কিছুটা দূরে
একটা নির্জন জায়গায় নিয়ে তাকে খুন
করব যেভাবে জনি কাল আমকে খুন
করেছিল। আস্তেআস্তে প্রচুর ভূত
বাড়াতে হবে আমাদের দলে।
আফটারঅল কিছুদিন পরে পৃথিবীর সব
মানুষ খুন করে আমরা ভূতেরাই তো
পৃথিবীর উপর রাজত্ব করব। এখন আমি
ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। এখন আমি আস্তিক।
একজন আস্তিক ভূত।
ডাক্তার। থাকি ঢাকায়। আমি ভূত বিশ্বাস করি না।
ভূত কেন আমিতো ঈশ্বরকেও বিশ্বাস
করিনা। যে সময় মানুষ চাঁদে যাচ্ছে,
মঙ্গলগ্রহ জয় করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ,
সেই যুগে আমি ভূত নামক মানুষ সৃষ্ট
একটা ভ্রান্ত ধারণাকে মনে ঠাঁই দিতে
পারিনা। আমার বন্ধুরা আমকে নাস্তিক
বলে। বলুক। আমার তাতে কিছু যায়
আসে না। আমি আমার বিশ্বাসে অটল।
কেউ টিটকারি দিয়ে আমকে আমার
বিশ্বাস থেকে একটুও নড়াতে
পারবেনা। আমি নাস্তিক। একজন নাস্তিক
মানুষ। 6 জুলাই, 2006। রাতে ডিনার করে
ইজিচেয়ারে বসে একটা বই পড়ছিলাম।
এসময় বিকট শব্দে বেজে উঠল আমার
পুরনো আমলের টেলিফোন
সেটটা। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে
শুনতে পেলাম আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু
আবিরের কন্ঠস্বর। কাজ করে করে
একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।
আবিরকে বলেছিলাম কক্সবাজারের
একটা টিকিট কনফার্ম করে রাখতে।
একারনেই ফোন করেছে ও।
পরশুদিন বিকাল 5 টায় ফ্লাইট। খুশি হয়ে
উঠল মনটা। যাক কয়েকটা দিনতো
অন্তত নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে পারব। 8,
জুলাই।
যথাসময়ে রওনা দিলাম আমি। চট্টগ্রাম
পৌঁছতে সন্ধ্যা 7টা বেজে গেল।
ট্যাক্সির খোঁজে এদিক ওদিক তাকাতেই
একটা ট্যাক্সি এসে আমার সামনে
দাঁড়ালো। ট্যাক্সির ড্রাইভারের বয়স
বড়জোর 26 কি 27 হবে। কক্সবাজার
যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করলাম। যাবে। উঠে
বসতেই ট্যাক্সি ছাড়ল ও কক্সবাজারের
উদ্দেশ্যে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ
বসে থাকলাম। কিন্তু কতক্ষণ আর চুপচাপ
বসে থাকা যায়? তাই ঠিক করলাম ড্রাইভার
ছেলেটার সাথেই আলাপ জমাবো।
“নাম কি তোমার?“ আলাপ জমানোর
প্রথম পদক্ষেপ হল প্রথমে
অন্যজনের নাম জিজ্ঞাসা করা, তাই নাম
দিয়েই আলাপ শুরু করলাম আমি। “জনি,“
একটু হেসে উত্তর দিল সে। ওর কাছ
থেকে জানলাম ও গ্রাজুয়েশন
করেছে। কিন্তু কোনও চাকরি না
পেয়ে শেষে ট্যাক্সি চালানো শুরু
করেছে। আলাপ করতে করতেই
চারদিকের অন্ধকারাচছন্ন দৃশ্য দেখতে
লাগলাম আমি। এক ঘন্টা হয়ে গেছে
প্রায়। সিটে হেলান দিয়ে ঝিমাতে
লাগলাম আমি। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনিতে উঠে
বসলাম। “কি ব্যাপার, জনি?“ জিজ্ঞাসা করলাম
আমি। “টায়ার পাংচার হয়ে গেছে, স্যার।
গাড়িতে এক্সট্রা কোন টায়ারও নাই,“
বিব্রত ভঙ্গিতে উত্তর দিল জনি।
“সেকি? এখন কি করব?“ কিছুটা রাগতো
স্বরে বললাম আমি। “একটা ফোন করা
লাগবে, স্যার“। “ ফোন এখানে
কোথায় পাব। নির্জন রাস্তা ছাড়া কোনও
বাড়িঘর বা দোকানপাটতো চোখে
পড়ছেনা।“ বললাম আমি। হঠাৎ একদিকে
আঙুল তুললো জনি “ঐ দেখেন স্যার
একটা বাড়ি“। ওর নির্দেশিত দিকে তাকালাম
আমি। সত্যিই তো একটা বাড়ি দেখা
যাচ্ছে। “জনি চলতো দেখি ওই বাড়িতে
টেলিফোন পাওয়া যায় কিনা?“ বললাম আমি।
বেশী দূরে না বাড়িটা। তবে আমদের
অবস্থান থেকে বাড়িটা পর্যন্ত ঘন
ঝোপঝারে ভরা। বাড়িটাতে পৌঁছে
চারদিকে তাকালাম দরজার খোঁজে।
পেয়েও গেলাম দরজাটা।
ডোরবেলের খোঁজ করলাম দরজার
আশেপাশে, কিন্তু পেলাম না। “চুলোয়
যাক ডোরবেল,“ বলে দরজায় নক
করল জনি। ভেতর থেকে কোনও
সাড়াশব্দ পেলাম না। এবার জোরে
জোরে দরজায় বাড়ি দিতে লাগল ও।
একটু পর ভিতর থেকে মৃদু পায়ের
আওয়াজ পেলাম। ভীত মুখে বয়স
তিরিশেক একজন মহিলা দরজা খুলে দিল।
সন্দেহ ভরা দৃষ্টি নিয়ে আমদের
দুজনকে দেখল। “কে আপনারা?“
ভীত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
আমি আমাদের সব সমস্যার কথা খুলে
বলতেই ভিতরে ডাকলেন আমাদের।
তারপর জনকে দেখিয়ে দিলেন
কোন ঘরে টেলিফোন আছে।
জন চলে গেল টেলিফোন করতে।
ভদ্রমহিলা আমাকে সোফায় বসতে
বললেন। বসে থেকে ঘরের
চারদিকে চোখ বুলাতে লাগলাম আমি।
দেয়ালে দেখলাম ঐ ভদ্রমহিলা এবং এক
ভদ্রলোকের ছবি। আমাকে ছবির
দিকে তাকাতে দেখে মহিলা নিজেই
বললেন “উনি আমার স্বামী, গত বছর
সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।” “ওহ! আমি
দুঃখিত।” উঁনাকে এই বিষয়ে আর কোন
প্রশ্ন করে বিব্রত করতে চাইলামনা। “
আপনারা বসুন, আমি চা নিয়ে আসি,”
আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে
উনি দ্রুত রান্নাঘরের দিকে চলে
গেলেন। জনি এখনও আসেনি। চুপচাপ
বসে আছি। এমন সময় সামনের ঘরের
দরজা খুলে গেল।
ভেতর থেকে বের হয়ে আসলো
একজন লোক। তাকে দেখেই
চমকে উঠলাম আমি। চট করে ছবির
দিকে তাকালাম, না কোনও সন্দেহ
নেই। ছবির ঐ ভদ্রলোক। ভদ্রলোক
আমাকে দেখে অবাক হলেন। “কে
আপনি, আমার বাসায় ঢুকলেন
কীভাবে?”এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস
করলেন তিনি। “আপনি,” ওনার প্রশ্নের
উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম,
“আপনি জীবিত আছেন? কিন্তু উনি যে
বললেন.........” “আমি জীবিত আছি
মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি,”
বিস্ময় ফুটে উঠল তার চেহারায়।
“আপনার স্ত্রী বললেন আপনি মারা
গেছেন,” বললাম আমি। রাগ ফুটে উঠল
তার চেহারায়,“ইয়ারকি করছেন আপনি
আমার সাথে? কি যাতা বলছেন আমার মৃতা
স্ত্রী সম্পর্কে?” “মৃতা স্ত্রী,”
বোমা ফাটল যেন আমার কানের
পাশে,“কি সব উল্টো পাল্টা কথা
বলছেন আপনি, আপনার স্ত্রী তো
বেঁচে আছেন। চা বানাতে গেছেন
আমাদের জন্য,“ চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।
“দেখুন যথেষ্ট হয়েছে,
একেতো বিনা অনুমতিতে আমার
বাড়িতে ঢুকেছেন, আবার আমার মৃতা
স্ত্রী সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলছেন।
আমি..........।” কথা শেষ করতে
পারলেননা উনি কারণ জনি এসে
দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। অবাক হয়ে
জনির দিকে তাকালেন তিনি। “তুমি কে,”
তার কন্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি “ কেউ কি
আমকে বলবে কি হচেছ এখনে?”
“দেখুন মিস্টার....... ,” “আমান, আমি আমান
চৌধুরি,” ধরিয়ে দিলেন তিনি। “ওকে,
মিস্টার আমান চৌধুরি, দেখুন আমদের
গাড়ির টায়ার আপনার বাড়ির সামনে এসে
পাংচার হয়ে যায়, আমরা আপনার দরজা নক
করতে আপনার স্ত্রী দরজা খুলে
দেয় আর আমকে এখানে বসায়ে
রেখে উনি চা বানাতে গেছেন, দয়া
করে রান্নাঘরে যেয়ে উনাকে
জিজ্ঞাসা করুন।”
“আমি জানিনা আপনি কি বলছেন, কিন্তু
আমার স্ত্রী গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায়
মারা গেছেন,” বললেন আমান চৌধুরি।
“What the hell you are talking about,”
প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, “আমরা একটু
আগে উনার সাথে কথা বলেছি, জনি তুমিই
বল।” “ আমি জানিনা আপনারা নেশা
করেছেন কিনা কিন্তু আমার স্ত্রী
গতবছরই মারা গেছে।” “Please trust
me, MR. Aman, আমরা দুজন একসাথে
ভুল দেখতে পারিনা।” “তাহলে আপনারা
নিশ্চয়ই ওর আত্মাকে দেখেছেন,”
রাগ সরে গিয়ে হাসি হাসি হয়ে উঠল তার
মুখটা। “আত্মা! কি বলছেন আপনি?” “ঠিকই
বলছি, কারণ এখন আমি ওর আত্মাকে
আপনাদের পিছনে দেখতে পাচ্ছি।”
পিছনে ঘুরেই চমকে গেলাম আমরা, ঐ
মহিলাই হাস্যজ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
“সরি মিস্টার..... , ওহ আপনার নামটাই তো
জানা হয়নি, যাইহোক আমি পলি চৌধুরী,
আমানের স্ত্রী।” হাসিমুখে বললেন
উনি। “ আমরা সত্যিই দুঃখিত মিস্টার.......”
জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে আমান চৌধুরি তাকালেন
আমার দিকে। “রহমান, আমি জুয়েল
রহমান।” নাম বললাম আমি। “ওকে, মিস্টার
জুয়েল রহমান, আমরা সত্যিই দুঃখিত, জাস্ট
একটু ফান করলাম আপনাদের সাথে।”
“ফান?” বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা
করলাম আমি।
“হ্যা, ফান। আসলে আমরা দুজন
লোকালয় থেকে অনেক দূরে থাকি।
দুজনের সংসার। জরুরী কাজ ছাড়া শহরে
যাওয়া হয় না খুব একটা। মানুষের সাথে খুব
বেশী মেশাও হয় না। একেবারে
রসকষহীন জীবনযাপন করি। তাই জানালা
দিয়ে আপনাদের আসতে দেখে
ভাবলাম একটু ফান করা যাক। তাই দুজনে
একটু ভূতের অভিনয় করলাম। যাইহোক
ভাই, কিছু মনে করেন না।” হাসলেন
আমান চৌধুরি। হাসলাম আমিও। এতক্ষণে সব
বুঝতে পারলাম। জনির মুখটা ভয়ে
ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল এইসব কাণ্ড
কারখানা দেখে। এবার সব কিছু বুঝতে
পেরে শান্ত হয়ে আমার পাশে এসে
বসল। মিসেস আমান আমাদের চা নাশতা
পরিবেশন করলেন। একটু পর দরজায়
শব্দ হল। মেকানিক এসে গেছে। দশ
মিনিটও লাগলনা টায়ার পাল্টাতে। মিস্টার এবং
মিসেস আমানকে বিদায় জানায়ে আমি
আর জনি আবার রওনা হলাম। ঘড়ির দিকে
তাকিয়ে দেখলাম সাড়ে দশটা বেজে
গেছে। “স্যার, খুব ভয় পেয়েছিলেন
বুঝি,” জনি জিজ্ঞেস করল। “ভয়?
হেসে উঠলাম আমি। “এই জুয়েল রহমান
কখনও ভয় পায়না, জনি।
আমি যদি পৃথিবীতে কিছু অবিশ্বাস করি তা
হল ভূত আর ঈশ্বর।” জনি অবাক হয়ে
আমার দিকে তাকাল। তাকাক। সবাই তাকায়।
আমার এতে কিছু যায় আসে না। “স্যার,
ভূতও আছে, ঈশ্বরও আছে। আপনি এটা
অস্বীকার করতে পারেননা।” জনির
কথার ধরন দেখে অবাক হলাম। “আচ্ছা?
তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে?
কীভাবে তুমি এত জোর গলায় বলছ
যে ভূত আছে?” হঠাৎ গাড়ি একটা
জোরে ঝাঁকি খেয়ে থেমে
গেল। আমার দিকে ঘুরলো জনি। ধ্বক
করে উঠল আমার
বুকটা। দেখলাম যেখানে জনির
চোখজোড়া ছিল সেখানে এখন শুধু
শুন্য কোটর ভয়ংকর ভাবে আমার দিকে
তাকিয়ে আছে। “আমি এত জোর দিয়ে
বলছি কারণ আমি নিজেই ভূত, স্যার।”
ঘড়ঘড়ে কন্ঠে বলল জনি। হঠাৎ
দেখলাম জনির চামড়া আস্তে আস্তে
খসে পরতে লাগল। ঠোঁট দুটো
খসে গিয়ে সেখানে উঁকি দিল ভয়ংকর
কাল দাঁতসহ কুৎসিত লাল মাড়ি।
পচা মাংসের তীব্র গন্ধে ভরে গেল
গাড়ির ভিতরটা। কিছুক্ষণ পরে ওর দেহে
আর মাংস বা চামড়া বলে কিছু থাকল না। শুধু
একটা ভয়ংকর কঙ্কাল বিদঘুটে ভাবে
আমার দিকে চেয়ে থাকল। অজান্তেই
তীব্র চিৎকার বেরিয়ে আসল আমার
গলা থেকে। কিন্তু এই নির্জন জায়গায়
আমার চিৎকার শোনার কেউ নাই। গাড়ির
দরজা খোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু
হাতদুটো যেন অসাড় হয়ে গেছে,
যেন কেউ সম্মোহিত করে
রেখেছে আমকে। আবার কুৎসিত
কঙ্কালটার দিকে তাকালাম। দেখলাম
ধীরে ধীরে ওটা একটা কুৎসিত হাত
বাড়িয়ে দিচ্ছে আমার দিকে। 9 জুলাই।
সন্ধ্যা 7 টা বাজছে প্রায়। আমি চট্টগ্রাম
এয়ারপোর্টের সামনে ট্যাক্সির ভিতর
বসে আছি। অপেক্ষা করছি একজন
প্যাসেঞ্জারের জন্য। শুধু আমি না
আমার মত আরও অনেক ভূত অপেক্ষা
করছে ট্যাক্সি নিয়ে।
একজন প্যাসেঞ্জার পেলেই তাকে
নিয়ে রওয়ানা হয়ে যাব। চট্টগ্রাম
হাইওয়ে থেকে বেশ কিছুটা দূরে
একটা নির্জন জায়গায় নিয়ে তাকে খুন
করব যেভাবে জনি কাল আমকে খুন
করেছিল। আস্তেআস্তে প্রচুর ভূত
বাড়াতে হবে আমাদের দলে।
আফটারঅল কিছুদিন পরে পৃথিবীর সব
মানুষ খুন করে আমরা ভূতেরাই তো
পৃথিবীর উপর রাজত্ব করব। এখন আমি
ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। এখন আমি আস্তিক।
একজন আস্তিক ভূত।