Forums.Likebd.Com

Full Version: গুলিবিদ্ধ রক্তমাখা পাঞ্জাবীটা
You're currently viewing a stripped down version of our content. View the full version with proper formatting.
গুলিবিদ্ধ রক্তমাখা পাঞ্জাবীটা
.
.
রাস্তার পাশে একটা যুবক ছেলের লাশ পরে আছে। ছেলেটার শরীর ধারাল অস্ত্র দ্বারা ঠান্ডা মাথায় ইচ্ছে মতো কোপানো হয়েছে। ডান হাতটা পাশেই পরে আছে। তবে শরীরের সাথে হাতের কোনো সংযোগ নেই।
.
রাত মাত্র নয়টা। রাত শেষ হলেই ঈদ-উল-ফিতরের নামায। অভির বাবা অফিস থেকে বাসায় ফিরছিলেন। দুই হাতে পরিবারের জন্য নতুন পোশাক নিয়ে শ্যামলী থেকে আদাবর নিজের বাসায় যাচ্ছিলেন। তিনি শ্যামলী থেকে এক বৃদ্ধ চাচার রিক্সায় ওঠেন।
.
বাসার কাছাকাছি যাওয়ার সময় একটা লোককে দৌড়াতে দেখে তিনি লোকটাকে ডাক দিলেন। কিন্তু লোকটা দৌড়াতেই থাকে। একবার পিছু তাকায় আবার দৌড়ায়। হটাৎ করেই পিছন থেকে চারজন মানুষের আগমন। তাদের দেখতে একদম ভদ্র লোকের মতোই দেখাচ্ছে।
.
_কি সমস্যা আপনারা এভাবে দৌড়ান কেন?(অভির বাবা)
_জনাব এখান দিয়ে সুটকেস হাতে করে কাউকে দৌড়াতে দেখেছেন? (চারজনের থেকে একজন)
_হুম, একজনকে সুটকেস হাতে করে এই রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে দেখেছি। কিন্তু আপনারা কে, আর কেনই বা লোকটার পিছু নিয়েছেন?
_ ধন্যবাদ আপনাকে। ঐ দৌড়া তারাতারি...
_ এই দাড়ান!
.
অভির বাবার শেষের কথাটা কেউ শুনে নাই। চারজন একসাথে অভির বাবার দেখানো রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে আরম্ভ করে।
.
অভির বাবা তাদেরকে দেখে বুঝতে পেরেছে যে তারা আসলে ভদ্রতার মুখোশ পরেছে। আসলে বাস্তবে তারা ভিন্ন। ঢাকার শহরে আজ বাইশ বছর। সবকিছু চেনাজানা তার। আর তাই চারজনকে ভুল পথ দেখিয়েছিল।
.
তিনি কিছুক্ষণ পরেই বাসায় পৌঁছেন। বাসায় গিয়ে মায়ের হাতে ঈদের পোশাক দিলেন। স্ত্রী মারা গেছে আজ ছয় মাস। বৃদ্ধ মা এখন সংসার দেখেন। বড় মেয়ে আরিশা রান্না এবং বাসাবাড়ির সব কাজ করে। এক এক করে বাসার সবাই যারযার পোশাক অভির দাদুর থেকে নিয়ে যায়। শুধু অভির পাঞ্জাবী আর প্যান্ট কেউ নেয়নি। অভি তার বন্ধুদের বাসায় পার্টিতে রয়েছে। সকাল সকাল চলে আসবে। অভির পোশাক গুলো তার দাদু তার আলমারিতে রেখে দিলেন।
.
রাত প্রায় ১০ টা। এমন সময় বাসার সামনে দিয়ে কিছু লোক "খুন হয়েছে! খুন হয়েছে! চিৎকার করে বলে যাচ্ছে।
.
অভির বাবা বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় গেলেন। প্রায় দশ থেকে বারো জন মানুষকে গোল হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখলেন। সামনে গিয়ে দেখেন সেই দৌড়ানো লোকটা শুয়ে আছেন। ডান হাতটা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাশেই পরে আছে। হুম লোকটা এখন আর বেঁচে নেই। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যায়।
.
রাত তিনটায় অভি বাসায় ফিরে। সবাই ঘুমিয়ে শুধু অভির বাবা জেগে আছেন। দরজা নক করতেই বাবা দরজা খুলে দেয়।
_বাবা তুমি এখনও ঘুমাও নি?(অভি)
_এতো লেট করে বাসায় আছিস কেন? আজ আমাদের বাসার সামনে একটা ছেলে খুন হয়েছে!(বাবা)
_হুম শুনেছি বাবা। আমার ঘুম পায়, আমি ঘুমাতে গেলাম
_খাবি না কিছু?
_না আমি খাবো না। আজ অনেক খেয়েছি।
_সকালে ফজর নামায এবং ঈদের নামায আদায় করবি।
_ঠিক আছে।
.
ফজরের নামায শেষ, কিন্তু অভি এখনও গভীর ঘুমে। আরিশা অভিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়।
_ভাইয়া, ০৭:৩০। আর কত ঘুমাবা? আব্বু আসলে দিবে বকা তারাতারি ওঠো। ঈদের নামাযটা কি পড়বা না?
_৭:৩০! ও মাই গড!
.
গোসল শেষে নতুন পাঞ্জাবীর খোঁজে আরিশাকে ডাক দেয় অভি।
_ আরিশা আব্বু কি কাল পাঞ্জাবী কিনেছে?
_হ্যাঁ ভাইয়া। দাদুর আলমারিতে দেখো। আমি নুডলস বসিয়েছি, তুমি একটু কষ্ট করে নিয়ে নাও।
_ ওকে।
.
দাদুর আলমারিতে অভি পাঞ্জাবী খুঁজতে গিয়ে অন্য একটা পাঞ্জাবী দেখে অবাক হয়ে যায়! আর অবাক হবে না কেন। একটা পাঞ্জাবীর মধ্যে রক্তের দাগ আর তিনটা ছিদ্র থাকা সত্বেও পাঞ্জাবীটা আলমারিতে এতো সুন্দর করে রেখেছে তা দেখে অবাক না হয়ে যাবে কোথায়! অভির চেঁচামেচি শুনে দাদু বারান্দা থেকে চলে আসেন।
_কি দাদু ভাই, পাঞ্জাবী খুঁজে পেয়েছো? (অভির দাদু)
_দাদু তুমি কি পাগল নাকি?(অভি)
_কেন কি হয়েছে? আর সকাল সকাল পাগল হবো কেন? এখনতো মাথা ঠান্ডা আছে। দুপুরবেলা না হয় একটু গরম সহ্য করতে না পারলে পাগল হয়ে যাবো। আমার দাদু ভাই তখন না হয় আমার মাথায় ঠান্ডা জল দিয়ে দিবে!
_তুমি সত্যি পাগল, না হলে এমন একটা পাঞ্জাবী কেউ আলমারিতে এভাবে সাজিয়ে রাখে?
_কোথায়, দেখি কোন পাঞ্জাবীর কথা বলতেছো?
_এই যে এই পাঞ্জাবীটা। দেখো তো পাঞ্জাবীতে শুকনো রক্তের দাগের মত দেখা যাচ্ছে এবং তার সাথে তিনটা বড় বড় ছিদ্র! তুমি দামী কাপড়ের সাথে এসব কি রাখো কিছুই বুৃঝি না। এই পাঞ্জাবীর জন্য সবগুলো পোশাক অপবিত্র হয়ে গেছে। এখন আমি কি আর আমাকে নতুন পোশাকে বিভূষিত করতে পারবো? এই পাঞ্জাবীতে কি আর নামায হবে? আসলেই তোমার মাথা খারাপ!
_ হ্যাঁ দাদু ভাই, আসলেই আমার মাথা খারাপ! আর এই পাঞ্জাবীর মানুষটার জন্যই আমার মাথা খারাপ। এই পাঞ্জাবীর মতো পবিত্র পোশাক আলমারিতে আর একটাও নেই।
_রক্তমাখা পাঞ্জাবী কখনও পবিত্র হতে পারে? আবোলতাবোল কি যে বলতেছো তুমি নিজেও জানো না।
_ আমি আবোলতাবোল বলছি না। শুনবা কেন বলেছি যে এই পাঞ্জাবীর মতো পবিত্র পাঞ্জাবী আর একটাও নেই?
_হুম বল।
_তখন আমি ছিলাম নতুন বৌ। ঐসময়ে আমার গর্বে তোমার বাবার আগমন হয়। আমাকে তোমার দাদা ভাই খুব ভালোবাসতেন। লোকটা ছিল মাটির মানুষ। একদিন সকালে তোমার দাদা ভাইয়ার একজন বন্ধু আমাদের বাসায় আসেন, যার নাম ছিল শাহজাহান।
.
শাহজাহান মিয়া তোমার দাদা ভাইকে ঘর থেকে বাহিরে ডেকে নিয়ে যায়। ঐযে উঁচু মাটি দেখা যায় না, ওখানে দাড়িয়ে দু'জন কথা বলেছিল। তারপর ঘরে এসে আমাকে এক যায়গা যাওয়ার কথা বলে চলে যেতে লাগলো। আমি তাকে ডাক দিয়ে খাবার খেয়ে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে চলে গেলেন। তখন আমার অনেক খারাপ লেগেছিল। তোমার দাদু ভাইকে বিদায় দিতে আদৌ চাইনি। কিন্তু লোকটা ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞা বদ্ধ। বন্ধুর সাথে যাবে বলেছো তো যাবেই।
.
দুপুর শেষ হয়ে বিকাল চলে আসে। কিন্তু তোমার দাদা ভাইয়ার আসার খবর নেই। আমার বুকটা কেমন যেন হু হু করে ওঠে। এমন সময় শাহজাহান মিয়ার আগমন।
_ভাবী আমার সাথে হাসপাতাল যেতে হবে। তারাতারি রেডি হয়ে নিন। সিরাজ অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।
_কি বলেন এসব! কিভাবে, কখন?
.
অতঃপর আমি শাহজাহান মিয়ার সাথে হাসপাতালে যাই। হাসপাতালে যেতে আমার না খুব কষ্ট হয়েছিল! তখন পা বাড়াতে পারি নাই। মনে হয়েছে শরীরের সকল শক্তি কে যেন ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। আমার চোখের জল দেখে শাহজাহান মিয়ার চোখেও জল চলে আসে।
.
আমি হাসপাতালে গিয়ে তোমার দাদাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখি। কি যে সুন্দর করে তিনি ঘুমিয়ছিল তা আগে কখনও দেখি নাই। আমি তাকে জাগিয়ে দেই নি। শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। তারপর আর আমার কিছুই মনে ছিল না। আমি জ্ঞানহারা হয়ে যাই। যখন সুস্থ হই তখন তোমার দাদা ভাই নতুন পৃথিবীতে চলে যায়।
.
উর্দু ভাষা এবং বাংলা ভাষা, এই দুই ভাষা রাষ্ট্র ভাষা করার লক্ষ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে দুইটি দল পৃথক হয়ে যায়। আমরা বাঙালি, আমাদের দেশে সবাই মায়ের ভাষা তথা বাংলা ভাষায় কথা বলে। হাতে গণা কিছু সংখ্যক মানুষ উর্দু ভাষায় কথা বলে। কিন্তু পাকিস্তানি লোভী এবং নিষ্ঠুর শাসক উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার লক্ষ্যে বিভিন্নভাবে চক্রান্ত করে। তাদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে বাংলার ছাত্র সমাজ প্রতিবাদ গড়ে তোলে।
.
শাহজাহান মিয়া এবং তোমার দাদা ভাই একই কলেজে পড়ালেখা করতেন। তাদের ফ্রেন্ড সার্কেলে একমাত্র তোমার দাদা ভাই বিবাহিত ছিলেন।
.
ঐদিন শাহজাহান মিয়া এবং তাদের সকল বন্ধুরা মিলে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেয়। সেখানে তোমার দাদা ভাইও ছিলেন।
.
রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে সবাই ব্যানার, ফেস্টুন হাতে নিয়ে মিছিলে অংশগ্রহণ করে। সবার মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি কি যে শ্রদ্ধা,মায়া, ভালোবাসা ছিল তা মিছিলে থাকা মানুষগুলো ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবে না।
.
মিছিল এগিয়ে যাচ্ছে তার নিজ গতিতে। সবাই যেন আজ রাষ্ট্র ভাষা বাংলা করার সংকল্পে মিছিলে নেমেছে। জীবন যাবে যাক, তবে বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পাক।
.
মিছিলের প্রভাব খুব বেশি ছিল। যে লোকটি দোকানে ছিল সেও দোকান বন্ধ করে বাংলা ভাষার দাবিতে মিছিলে যোগ দেয়। রাস্তায় তখন শুধু স্লোগান আর স্লোগান বয়ে যাচ্ছিল। তখন তোমার দাদা ভাই নাকি শাহজাহান মিয়াকে বলেছিল "দেখবি শাহজাহান আমরাই জয়ী হবো। এদেশের অন্যতম ভাষা বাংলা ভাষাই রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পাবে" (অভির দাদু কথা বলে আর কাঁদে)
.
কিছুক্ষণ পর মিছিলের স্লোগান বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশের গুলি বৃষ্টির মতো বর্ষিত হতে থাকে। পাকিস্তানি নিষ্ঠুর শাসকের নির্দেশে পুলিশের গুলিতে প্রাণ যায় কত মায়ের ছেলের। সেখানে আমার প্রাণ প্রিয় স্বামীর বুকে পুলিশের গুলি এসে বিদ্ধ হয়। একটা না, দুইটা না, তিনটা গুলিবিদ্ধ হয় তার বুকে।
রাস্তায় পরে থাকে কত মায়ের সোনা মানিকদের মৃতদেহ। সেনাবাহিনী গাড়িতে করে নিয়ে যায় রাস্তায় পরে থাকা মৃত দেহ গুলো। তুমি হয়তো জানো যে শহীদদের সঠিক মৃত সংখ্যা এখনও নির্ধারিত করা সম্ভব হয়নি। তার কারণ লাশ ঘুম করা।
.
তোমার দাদা ভাইয়ের বন্ধুরা তোমার দাদা ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু হাসপাতালে যাওয়ার পূর্বে তার মৃত্যু হয়। সেইদিন তোমার দাদা ভাই আমার বাবার কিনে দেওয়া পাঞ্জাবী বিভূষিত করে মিছিলে গিয়েছিলেন। এই রক্তমাখা, তিনটি গুলিবিদ্ধ পাঞ্জাবীটা ঐদিন তোমার দাদা ভাইয়ের শরীরে ছিল। তাই আজও তার পাঞ্জাবীটা যত্নসহকারে আলমারিতে সাজিয়ে রেখেছি। তুমি বল এটা কি অপবিত্র? এই পাঞ্জাবীর মতো পবিত্র আর কোনো পোশাক এই আলমারিতে আছে বল?
_ দাদু আমাকে ক্ষমা কর। সত্যি আমি বুঝতে পারিনি। আমি তো জানতাম আমার দাদা ভাই ভাষা আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু গুলিবিদ্ধ পাঞ্জাবীর কথা জানতাম না।(কথাগুলো কান্না করেই অভি বলতে থাকে)
.
তারপর অভি তার দাদুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। ঈদের দিন অভি এভাবে কান্না করবে তা কখনও ভাবেনি। তবে কান্নার মধ্যে একটা প্রশান্তি ছিল। যা অভি ছাড়া আর কেউ কখনও বুঝবে না।
.
বিশ্বের ইতিহাসে ভাষার জন্য একমাত্র বাঙালিরাই জীবন দেয়। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের ইতিহাসে ভাষার জন্য জীবন দিতে হয়নি। তাজা রক্তের দামে কেনা আমাদের এই বাংলা ভাষা। আমরা গর্বিত আমাদের ভাষা শহীদদের নিয়ে। তাদের পবিত্র রক্তের বিনিময়ে আজ বিশ্বে ২১ শে ফেব্রুয়ারি নামে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন হচ্ছে।
.
কিন্তু কষ্ট লাগে এখনও স্বাধীন দেশে যুবকের লাশ রাস্তায় পরে থাকে। পরে থাকে যুবতী মেয়ের ধর্ষিত মৃতদেহ! আবার কেউ ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে হিন্দি গান দিয়ে উদযাপন করে। ভাবতেই কষ্ট লাগে আমারা ভাঙালি! সত্যি কি আমরা বাঙালি?
.
✎ ✍_অভি(পাগলির পঁচা)

.
picture art by M.A. Moon