Forums.Likebd.Com

Full Version: বৃহস্পতি ও মঙ্গলের মাঝে গ্রহাণু এল যেভাবে
You're currently viewing a stripped down version of our content. View the full version with proper formatting.
সূর্য থেকে ৭৭৮.৩ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে
অবস্থিত সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতি। সূর্য থেকে
অবস্থানের দিক থেকে এটি সৌরজগতের পঞ্চম গ্রহ।
বৃহস্পতির আগে থাকা বাকি চারটি গ্রহ বুধ, শুক্র,
পৃথিবী ও মঙ্গলের সূর্য থেকে দূরত্ব যথাক্রমে ৫৭.৯,
১০৮.২, ১৪৯.৬ ও ২২৭.৯ মিলিয়ন কিলোমিটার। এই
দূরত্বগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় মোটামুটি
একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর গ্রহগুলো অবস্থান করছে।
এ হিসাবে সূর্য থেকে বৃহস্পতির ৭৭৮.৩ মিলিয়ন
কিলোমিটার দূরত্ব অত্যন্ত বেশি বলে মনে হয়।
মঙ্গল ও বৃহস্পতি দুই গ্রহের মধ্যে বেশি দূরত্বের
বিষয়টি সর্বকালের অন্যতম সেরা
জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলারের চোখে
ধরা পড়েছিল। তাই তিনি ১৫৯৬ সালে জার্মান
ভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থ ‘মিস্ত্রিয়াম
কসমোগ্রাফিকাম’ (ইংরেজি- দ্য কসমোগ্রাফিকাল
মিস্ট্রি)-তে লিখেছিলেন, ‘মঙ্গল এবং বৃহস্পতির
মাঝখানে আমি একটি গ্রহ রাখতে চাই। আমি খুঁজে
না পেলেও ভবিষ্যতে হয়তো এখানে কিছু আবিষ্কৃত
হবে। এই বিশাল জায়গায় অবশ্যই কিছু থাকার কথা।’
পরবর্তীকালে বড় বড় বিজ্ঞানীরা শক্তিশালী
দূরবীন কিংবা টেলিস্কোপ দিয়েও এই শুন্য স্থানে
নতুন কোনো গ্রহ আবিষ্কার করতে পারেননি। তবে
কেপলারের কথা একেবারেই বৃথা যায়নি। গ্রহের
বদলে এই স্থানটিতে সন্ধান মিলেছে প্রায় লাখ
খানেক গ্রহাণুর। যেগুলো গ্রহের মতোই সূর্যকে
প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু গ্রহাণু আসলে কি?
‘গ্রহাণু’ শব্দটিকে সম্প্রসারণ করলে দেখা যায়-
গ্রহের অণু থেকে গ্রহাণু হয়েছে। মূলত এভাবেই
শব্দটির উৎপত্তি। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধারণা
এককালে পুরো একটি গ্রহ সত্যিই এখানে ছিল। কিন্তু
কোনো ধূমকেতুর আঘাতে কিংবা অন্য কোনো
কারণে গ্রহটি ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল বলেই
তার টুকরোগুলো অর্থাৎ গ্রহাণুগুলো আলাদা আলাদা
হয়ে গ্রহের মতোই সূর্যকে নিয়মিতভাবে প্রদক্ষিণ
করে চলছে।
আমরা জানি, ১৯৯৪ সালের ১৬ জুলাই বৃহস্পতির সঙ্গে
‘শুমেকার লেভি’ নামক একটি ধূমকেতুর সংঘর্ষ হয়,
গ্যালিলিয় নভোযান দৃশ্যটি ধারণও করে। তবে
ধূমকেতুটি আকারে ছোট হওয়ায় বৃহস্পতির বিশেষ
কোনো ক্ষতি হয়নি। সুতরাং ধূমকেতুর কিংবা
অন্যকোনো মহাজাগতিক কিছুর আঘাতে কোনো গ্রহ
চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। যে
কারণে গ্রহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গ্রহাণুর উৎপত্তি
বিষয়টাকেই অধিকাংশ বিজ্ঞানীরা মেনে
নিয়েছেন।
বৃহস্পতি এবং মঙ্গলের মাঝখানে প্রথমবারের মতো
কোনো বস্তুর সন্ধান মেলে ১৮০১ সালের ১
জানুয়ারি। বর্তমানে ইতালিতে অবস্থিত সিসিলির
পালোরমে মানমন্দিরের অধ্যক্ষ গিসেপ্পি
পিয়াৎসি এদিন এমন একটি তারার সন্ধান পান যার
চলন ঠিক তারার মতো নয়। এরপর তিনি এই তারার চলন
পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেন। পিয়াৎসির পর্যবেক্ষণ-
লব্ধ তথ্য নিয়ে হিসাব কষে বিখ্যাত গণিতজ্ঞ গাউস
ঘোষণা করেন, এটি আসলে কোনো তারা নয়, এটি
একটি গ্রহ।
এরপর গ্রিক দেবি ডিমিটারের রোমান নাম
অনুসারে পিয়াৎসে এই গ্রহটির নাম দেন ‘সিরিস’।
সূর্য থেকে সিরিস-এর দূরত্ব ৪৩ কোটি ৩২ লাখ
কিলোমিটার। সূর্যের চারিদিকে একবার ঘুরে
আসতে এর সময় লাগে ৪.৬ বছর। কিন্তু গ্রহটির ব্যাস
৮০০ কিলোমিটারেরও বেশ অনেক কম। সুতরাং
বিজ্ঞানীরা একে গ্রহের মর্যাদা দিতে নারাজ
হলেন। এদিকে সিরিস-এর ওই একই অঞ্চলে ১৮০২
সালের মার্চে আবিষ্কৃত হল আরেকটি ক্ষুদ্রাকৃতির
গ্রহ। এর নাম দেওয়া হল ‘পালাস’। পরবর্তী পাঁচ
বছরের মধ্যে আবিষ্কৃত হল এরূপ আরো দুইটি গ্রহ-
‘জুনো’ ও ‘ভেস্তা’। এবারও এদের গ্রহ নামটি খারিজ
করে দেওয়া হল। বলা হল আসলে এরা গ্রহ নয় বরং
গ্রহের অনু বা খণ্ডাংশ। সেখান থেকেই এর নাম হল
গ্রহাণু।
অতঃপর পর্যায়ক্রমে আবিষ্কৃত হতে লাগলো আরো
গ্রহাণু। যেমন-হেবে, ফ্লোরা, মেতিস, আইডিএ,
হাইজিয়া, ইরোস, ভিক্টোরিয়া, ইউজিনিয়া,
এগেরিয়া, থেটিস, ফরচুনা, বেল্লোনা, ফিদেস সহ
আরো অনেক গ্রহাণু। বর্তমানে এই সংখ্যা দু হাজার
ছাড়িয়ে গেছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা এই সংখ্যা
লক্ষাধিক হতে পারে।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, আমাদের সৌরজগতের কিছু
বড় বড় গ্রহের যেমন চাঁদ আছে, তেমনি কিছু গ্রহাণুরও
চাঁদের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। ১৯৯৩ সালে ১৯ মাইল
বিস্তৃত ‘আইডিএ’ নামক গ্রহাণুর একটি ছোট উপগ্রহ
আবিষ্কৃত হয়েছে যার নাম রাখা হয় ‘ড্যাক্টেইল’। এর
বিস্তীর্ণতা প্রায় ১ মাইলের মতো। এরপর ১৯৯৯
সালে ৮ মাইল বিস্তীর্ণ একটি উপগ্রহ আবিষ্কার হয়,
এর নাম রাখা হয় ‘পেটিট প্রিন্স’। এই উপগ্রহটি প্রায়
১৩৫ মাইল বিস্তীর্ণ গ্রহাণু ইউজিনিয়াকে-কে
প্রদক্ষিণ করে। ২০০০ সালে ৯০ মাইল বিস্তীর্ন গ্রহাণু
পুলকোভার’র উপগ্রহ আবিষ্কৃত হয় যার বিস্তৃতি প্রায়
৯ মাইল। এখনো পর্যন্ত প্রায় ২ ডজনেরও বেশি
গ্রহাণুর উপগ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে।
এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্রহাণুদের মধ্যে বৃহত্তম হল
সিরিস। এর ব্যাস ৬৮৩ কিলোমিটার। তারপর রয়েছে
ভেস্তা, এর ব্যাস ৫৯২ কিলোমিটার। এই গ্রহাণুটি
আমাদের পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে রয়েছে। যে
কারণে একমাত্র এই গ্রহাণুটিকেই পৃথিবী থেকে
খালি চোখে দেখা যায়।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে ‘সিরিস’-এ বিভিন্ন
প্রাণীর যে ধরনের গল্প আমাদের কল্পনার সঙ্গী
হয়ে একটি নতুন জগৎ তৈরি করে আসলে সেই ‘সিরিস’-
এ জীবন কি, কোনো ছিটেফোঁটা বায়ুমণ্ডলও নেই, যা
কোনো জীবন তৈরির ক্ষেত্রে অপরিহার্য। এবং এত
ছোট মহাকাশীয় বস্তুতে বায়ুমণ্ডল সম্ভবও নয়। আসলে
গ্রহাণুগুলো আয়তনে এতই ক্ষুদ্র যে, এদের সবাইকে
একত্র করলে আমাদের চাঁদের সমান হওয়াটাই কঠিন।
তবে ছোট হলে কি হবে গ্রহের মতোই
নিয়িমিতভাবেই নিজ অক্ষের চারিদিকে পাক
খেতে খেতে সূর্যকে আবর্তন করে বৃহস্পতি ও
মঙ্গলের মাঝে থাকা এই গ্রহাণুগুলো। তবে বৃহস্পতি ও
মঙ্গলের মাঝেই শুধু গ্রহাণুর অস্তিত্ব নাকি সীমাবদ্ধ
নয়। নেপচুন-প্লুটোর পরে লাখ লাখ গ্রহাণু দ্বারা
সমস্ত সৌরজগৎ পরিবেষ্টিত বলে বিজ্ঞানীদের
ধারণা। তবে সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য এখনো
পাওয়া যায়নি।
বৃহস্পতি ও মঙ্গলের মাঝে থাকা এই গ্রহাণুগুলো
নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে ২০০১ সালে নাসা ‘নিয়ার’
নামক একটি মহাকাশযান প্রেরণ করে। ওই বছরের ১২
ফেব্রুয়ারি মহাকাশযানটি ‘ইরোস’ নামক একটি
গ্রহাণুতে নামে। এবং এটিই ছিল গ্রহাণুতে কোনো
মহাকাশযানের অবতরণ। এর আগে ২০০০ সালের ১৪
ফেব্রুয়ারি থেকে মহাকাশযানটি প্রায় ১ বছর ধরে
ইরোসকে প্রদক্ষিণ করে। তবে এরপরে শুধুমাত্র
গ্রহাণুর উদ্দেশে আর কোনো মহাকাশযান প্রেরণ
করা হয়নি। ভবিষ্যতে হয়তো কখনো গ্রহাণুর উদ্দেশে
প্রেরণ করা হবে নতুন কোনো মহাকাশযান আর তখন
হয়তো আমরা এদের সম্পর্কে নতুন কিছু জানতে
পারবো।
তথ্য সহায়তা :
* দ্য কসমোগ্রাফিকাল মিস্ট্রি: জোহানেস
কেপলার
* লস্ট প্রিয়ডিক কমেট: এম ম্যায়ার
* তারার দেশে হাতছানি: আবদুল্লাহ আল মুতী
* সূর্যের বন্দী: শঙ্কর সেনগুপ্ত
* অ্যাস্ট্রয়েডস: নাসা, জেট প্রপালশন
ল্যাবরোটারি, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১০।