01-17-2017, 07:24 PM
ঘটনার শুরু আজ থেকে চার বছর আগে
এক রাতে। আমি সিলেট এর ওসমানী
মেডিকেল এ একটা সেমিনার শেষ
করে নিজেই ড্রাইভ করে ফিরছিলাম
ঢাকায়। সাধারণত আমার পাজেরো টা আমার
খুব প্রিয় হওয়াতে আমি কাউকে ড্রাইভার
রাখিনি। সেদিন ও আমি নিজেই চালিয়ে
নিয়ে আসছিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে।
পথে খানিক টা ঘুম ঘুম ভাব আসলেও মন
টা সতেজ ছিল- কারন সেই সেমিনারে
আমি আমার গবেষনার জন্য পেয়েছি
প্রচুর হাততালি। সাংবাদিক রা ফটাফট ছবি তুলে
নিয়েছিল আমার। পরদিন পত্রিকায় আমার
ছবি সহ লিড নিউজ ও হবার কথা ই ছিল এবং
হয়েছিল ও তাই। আমি একটা বিশেষ হার্ট
সার্জারি আবিষ্কার করেছিলাম- যেটা আজ
পৃথিবীর সব দেশে দেশে
রোগীদের জীবন বাঁচাচ্ছে-
মানুষকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে নতুন
জীবনের।সেমিনারের সফলতা তাই
জুড়ে ছিল আমার মনে প্রানে। রাস্তায়
যেতে যেতে সেদিন আমি গান
শুনছিলাম। গানের তালে তালে ধীর
গতিতে গাড়ি চালাই আমি। বেশি গতি আমি
কখনোই তুলিনা।সেদিন ও ৫০ এর
কাছাকাছি গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। সিলেট
থেকে রওনা দিয়ে উজানভাটি এলাকার
কাছাকাছি আসতেই হটাত করে আমার
সামনে এক সাদা পাঞ্জাবি পড়া বৃদ্ধ লোক
এসে দাঁড়ায়। রাত তখন প্রায় দুইটা। এই
সময় রাস্তায় হাইওয়ের গাড়ি গুলো ছাড়া
কোন যানবাহন ও ছিলনা। হটাত করে
আমার সামনে কোত্থেকে লোকটা
এসে পড়ল কিছু বুঝে ওঠার আগেই।
আমি ও লোকটাকে বাঁচাতে গিয়ে ও
পারলাম না। সোজা সেই লোকের
ঊপর চালাতে বাধ্য হলাম। আর
সেখানেই গাড়ির সামনের অংশে বাড়ি
খেয়ে লোকটা ছিটকে পড়ল হাত
পাঁচেক দূরে। আমি হার্ড ব্রেক কষে
সেইবৃদ্ধের কাছে ছুটে গেলাম।
কিন্তু ততক্ষনে সব শেষ। মাথার কাছটায়
আঘাতে মৃত্যু বরন
আমি কোন দিন এক্সিডেন্ট করিনি।
সেটাই ছিল আমার প্রথম এক্সিডেন্ট।
আমি দিশেহারা হয়ে যাই। কিভাবে কি করব
বুঝে ঊঠতে না পেরে কিছুক্ষন ঝিম
মেরে থাকলাম সেখানেই। তারপর
বৃদ্ধকে গাড়িতে তুললাম। পাশে বসিয়ে
আবার ড্রাইভ করলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে।
ঢাকায় পৌছে সোজা মেডিক্যাল এ নিয়ে
গেলাম লাশ টাকে। সেখানে গিয়েই
পুলিশ কে জানানো হল। পুলিশ এসে
আমার কাছ থেকে জবানবন্ধি নিয়ে লাশ
টা থানায় নিয়ে গেল। আমি প্রথমে ঠিক
করেছিলাম পুলিশ কে সব খুলে বলব।
কিন্তু পরে কি ভেবে যেন আমি
মিথ্যে বলি। পুলিশ ও আমার কথা গুলো
কোন রকম সন্দেহ ছাড়াই বিশ্বাস
করে। নিজের কাছে আমি কিছু টা
অপরাধী বোধ করলে ও নিজের
ইমেজ বাঁচাতে এই মিথ্যেটা আমাকে
বলতেই হয়েছে। তারপর কেটে
গেছে অনেক গুলো মাস। আমি আমার
আবিষ্কৃত প্যারা সার্জারি সিস্টেম এর জন্য
অনেক গুলো পুরষ্কার ও পাই। খ্যাতি
আর অর্থ দুটোই এসে ধরা দেয়
আমাকে। ধীরে ধীরে নিজের
উপর আত্মবিশ্বাস বেড়ে চলে আমার।
নিজেকে কিছুটা ঈশ্বরের
সমপর্যায়ের ভাবতে থাকি। এরজন্য মিডিয়া
ও কম দায়ী নয়।খবরের পাতায় কারো না
কারো জীবন বাঁচানোর জন্য আমি
ঊঠে আসতে থাকি নিয়মিত ভাবে।
ধীরে ধীরে আমি অনেক অনেক
বেশী অহংকারী হয়ে ঊঠি। কাউকেই
পরোয়া না করার একটা ভাব চলে আসে
আমার মাঝে। মানুষ কে আমি মনে
করতে শুরু করি হাতের পুতুল। আমি
চাইলেই যেকোন মৃত্যু পথযাত্রীর
জীবন বাচিয়ে দিতে পারতাম। এই জন্য
আমার কাছেই ছুটে আসতে লাগল
হাজারো মানুষ। এই যশ আর খ্যাতি যখন
তুঙ্গে তখন আমার
কাছেই রুগী হয়ে আসেন
বাংলাদেশের প্রথিত যশা রাজনীতিবিদ
রেজোয়ানুল হক। আমি বাকি সবার মত
উনাকেও আস্বস্থ করেছিলাম যে উনার
কিছু ই হবেনা। যেদিন উনার অপারেশন –
সেদিন আমি আরো দুটি হার্ট অপারেশন
করে ফেলেছিলাম। তাই কিছু টা ক্লান্তি
ছিল। একটানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপারেশন
গুলো করতে হয়। তাই ক্লান্তি ভর
করে সহজেই। আমি ক্লান্ত থাকলে ও
মনে মনে পুলকিত ছিলাম কারন এর
পরেই আমি রেজোয়ানুল হকের
অপারেশন করবো। উনাকে যখন
অজ্ঞান করা হল তখন আমি নিজের
কস্টিউম পড়ছি। জুনিয়র ডাক্তার কে
দিয়েই এগুলো করাই আমি। আমি শুধু
গিয়ে কাটাকাটির কাজ টা করি। সেদিন ও
জুনিয়র তিনজন ডাক্তার মিলে সব
প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা সেরে
আমাকে কল দিল। আমি ও গেলাম। আর
গিয়েই শুরু করলাম অপারেশন। ওপেন
হার্ট সার্জারি ছিল সেটা। আমি যখন সব
কেটে কুটে মাত্র হার্ট টাকে
দেখতে লাগলাম এমন সময় আমার
চোখ গেল ওটি রুমের বাম কোনায়।
সেখানে আমার দিকে তাকিয়ে বসে
আছে সেই বৃদ্ধ। আমি দেখে
চোখের পলক ফেলতেই দেখি উনি
নেই। হ্যালুসিনেশন মনে করে আবার
অপারেশন শুরু করলাম। রেজোয়ানুল
হকের হার্ট এর নিলয় এর দুটো শিরায়
চর্বি জমেছিল। আমি সেগুলো পরিষ্কার
করতে করতে হটাত করে কানের
কাছে একটা কাশির শব্দ শুনলাম। প্রথমে
পাত্তা দিলাম না। কারন এইখানে কোন ভুল
হলেই রোগী মারা যাবেন। আমার
কোন রকম ভুলের কারনে এতবড়
মানুষ টার মৃত্যু হবে ভেবে আমি আবার
মনযোগ দিলাম। কিন্তু আবার কাশির শব্দ
আসল। কাশিটা আসছিল বাম দিক থেকে।
আমি বামে মাথা ঘুরিয়ে দেখি বৃদ্ধ হাসি হাসি
মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঠোট
নাড়ার আগেই বলে ঊঠল – “বাবাজি তুমি
তো উনাকে বাঁচাতে পারবানা” আমি অবাক
হয়ে গেলাম। আমি আকাশ পাতাল চিন্তা
করে চলেছি। একজন মৃত মানুষ কিভাবে
আমার পাশে এসে দাড়াতে পারে
সেটাই মাথায় আসছিল না। আমি কোন
উত্তর দেবার আগেই সেই লোকটি
বলল- “ কি বুঝতে পারছো নাতো?
শোনো- আমি জানি তুমি অনেক চেষ্টা
করবে উনাকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু
পারবেনা”- বলেই আবার হেসে দিল সাদা
পাঞ্জাবি পড়া বৃদ্ধ। আমি বিহ্বল হয়ে
তাকিয়ে আছি উনার দিকে। কি বলব
বুঝতে পারছিনা। উনাকে কি বলবো
বুঝতে বুঝতে কাটিয়ে দিলাম পাঁচ
সেকেন্ড। তারপর আবার মনযোগ
দিলাম অপারেশনে। রোগীর
অপারেশন সাকসেস হল। আমি ও হাপ
ছেড়ে বাঁচলাম। সেলাই করে দিয়ে
শেষ বার ড্রেস করতে দিয়ে আমি
মাস্ক খুলতে যাব এমন সময় হটাত করে
রোগীর পালস রেট গেল বেড়ে।
মেশিন গুলো যেন চিৎকার শুরু করে
দিয়েছে। হটাত করে বুকের ভেতর
ধপধপ করা শুরু করল। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে
রোগীর প্রেশার দেখলাম-
বেড়েই চলেছে প্রেশার। হটাত
করে এই অবস্থা হবার কথা না। আমি
কয়েকজন ডাক্তারকে বললাম
প্রেশারের ইনজেকশন দিতে। ওরা
সেটা দিতেই প্রেশার ডাউন হওয়া শুরু
করল। কিন্তু আবার ও বিপত্তি। এবার
প্রেশার
কমতে লাগল। আমি আবার টেনশনে
পড়ে গেলাম। কিন্তু কোনভাবেই কিছু
করতে পারলাম না। রোগীর হার্ট বিট
ভয়ানক ভাবে কমতে কমতে
একেবারে শুন্য হয়ে গেল নিমিশে।
এবং আমি তাকিয়ে তাকিয়ে রেজোয়ানুল
হকের মরে যাওয়া দেখলাম। প্রথম বার
আমার সামনে এক রোগী বলে
কয়ে মরে গেল- আমি কিছুই করতে
পারলাম না। আমি আমার রুমে এসে বসে
পড়লাম। রাগে আমার গা জ্বলতে শুরু
করল। নিজেকে অনেক অসহায় মনে
হতে লাগল। পরদিন বিভিন্ন পত্রিকায়
রেজোয়ানুল হকের পাশাপাশি আমার
হতাশাগ্রস্থ মুখ ও প্রকাশিত হল। মিডিয়া এমন
এক জিনিস- কাঊকে মাথায় তুলতে
দেরী করেনা- কাউকে মাটিতে আছাড়
মারতে ও দেরী করেনা। আমাকে ও
মাটিতে নামিয়ে আনল ওরা। আমার
বিরূদ্ধে হত্যা মামলা রজু করা হল সেই
নেতার দলের লোকজনের পক্ষ
থেকে। কিন্তু সরকার আমার পাশে ছিল
বলে মামলা ধোপে টেকেনি। টাকা
পয়সা খাইয়ে পুলিশ আর আদালতের
সবকটাকে কিনে নিয়েছিলাম। তারপর
আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। আমি ও
ফিরে আসি বাস্তব জীবনে।
রোগীদের সেবায় মনযোগ দেই।
ছোটখাট অপারেশন এ যোগ যেই।
এরপর আসতে আসতে আমার জীবন
স্বাভাবিক হয়ে ঊঠে। কিন্তু এর ঠিক ছয়
মাস পড়েই এই মহিলা ডাক্তার কে
অপারেশনের দায়িত্ব পরে আমার উপর।
আমি নিরুপায় ছিলাম। উনাকে আমি
কর্মজীবনে শ্রদ্ধা করতাম। আমার
শিক্ষিকা ছিলেন। উনার হার্টে ব্লক ধরা
পড়াতে উনাকে অপারেশনের দায়িত্ব
উনি নিজেই আমাকে দেন। খুব ছোট
অপারেশন। হরহামেশাই এই ধরনের
অপারেশন হত-এখন ও হয়। হার্টের যে
ধমনী গুলো ব্লক হয়ে যায়
সেগুলোতে রিং পড়ানোর কাজ। আমি
প্রথমে রাজি হইনি। কিন্তু রোগীর
পীড়াপীড়ি তে রাজি হই।
অপারেশন টেবিলের সামনে এসেই
আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। কারন
সেখানে সেই দিনের মতই বাম
কোনায় বসে ছিল সেই বৃদ্ধ। উনাকে
দেখেই বুকের ভেতর কেমন যেন
করে উঠে আমার। অজানা আশংকায়
কেঁপে উঠে মন। কিন্তু বাধ্য হয়ে
আমাকে অপারেশন করতে হয়। আমি ও
শুরু করি। হার্টের ধমনী একটাতে রিং
পড়ানো শেষ করে আরেকটা যখন
ধরবো এমন সময় কানের কাছে
ফিসফিস করে বৃদ্ধ সেই আগের মতই
বলল- “বাবাজি- আজকা ও তুমি উনারে বাচাতি
পারবানা” হাসি হাসি মুখের ভেতর যেন
রাজ্যের ঘৃণা। আমি উনার চেহারার দিকে
এক পলক তাকিয়েই আবার কাজ শুরু
করলাম। কিন্তু রিং পড়াতে গিয়েই হটাত
করে ভুল করে কেটে গেল ধমনী
টা। গলগল করে রক্ত বের হতে শুরু
করল। নিরুপায় হয়ে তিন চার জন মিলে
সেই রক্ত বন্ধ করে ধমনী পরিষ্কার
করে জোড়া লাগাতে বসল। আমি
নিজেও হাত দিলাম। কিন্তু যা হবার তাই হল।
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে রোগীর
অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেল। আমি
রক্তের জন্য লোক পাঠালাম। কিন্তু
সামান্য ও পজেটিভ রক্ত সেখানে
ছিলনা। এতবড় একটা হাসপাতালে ও
পজেটিভ রক্ত না পেয়ে সেই ডাক্তার
আপা মারা গেলেন চোখের সামনে।
আমার কিছু ই করার ছিলনা। এরপর একদম
ভেঙ্গে পড়েছিলাম আমি। আমার পরিবার
থেকে বিয়ে করার জন্য চাপ আসল।
আমি ও বিয়ে করলাম। মিতি- আমার বৌ-
লক্ষ্মী বৌ আমার। যাকে বলে
একেবারেই আটপৌরে মেয়ে। বিয়ে
হয়েছে আমাদের মাত্র তিন সপ্তাহ।
এরমাঝেই আমাকে করেছে আপন।
কিন্তু ভাগ্য সহায় না থাকলে যা হয়- বিয়ের
তিন সপ্তাহের মাথায় ওর আব্দার রাখতে
গেলাম কক্সবাজার এ। সেখানে প্রথম
দিনেই একটা আছাড় খেল মিতি বাথরুমে।
প্রথমে আমি তেমন কিছু না বলে পাত্তা
না দিলে ও পরে বুঝতে পারি মিতির
কোন একটা বিশেষ সমস্যা হয়েছে।
তখনই আমি মিতিকে নিয়ে আসি ঢাকায়।
পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানতে পারি
মিতির মাথায় রক্তক্ষরণ হয়েছে
আছাড়ের ফলে। খুব দ্রুত মিতিকে
অপারেশন করাতে হবে। নিজের
স্ত্রী বলে মিতির অপারেশন আমি
করতে চাইনি। কিন্তু সেই মুহূর্তে সব
ভাল ভাল সার্জন রা দেশের বাইরে
থাকাতে আমাকেই দায়িত্ব নিতে হল।
আমি ও মেনে নিলাম অর্পিত দায়িত্ব। আমি
এখন বসে আছি মিতির রুমের সামনে।
আরেকটু পর মিতির অপারেশন। আমি
মিতির দিকেই তাকিয়ে ছিলাম- কিন্তু হটাত
করে চোখ গেল মিলির কেবিনের
বাম কোনায়। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে
সেই বৃদ্ধ। জানিনা কি হবে আজকে।
যে কোন ভাবে মিতিকে বাঁচাতেই
হবে। কিন্তু আজরাইলের বেশে
বৃদ্ধের মুচকি হাসি দেখে আমার আশার
প্রদিপ নিভতে শুরু করে দিয়েছে…
এক রাতে। আমি সিলেট এর ওসমানী
মেডিকেল এ একটা সেমিনার শেষ
করে নিজেই ড্রাইভ করে ফিরছিলাম
ঢাকায়। সাধারণত আমার পাজেরো টা আমার
খুব প্রিয় হওয়াতে আমি কাউকে ড্রাইভার
রাখিনি। সেদিন ও আমি নিজেই চালিয়ে
নিয়ে আসছিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে।
পথে খানিক টা ঘুম ঘুম ভাব আসলেও মন
টা সতেজ ছিল- কারন সেই সেমিনারে
আমি আমার গবেষনার জন্য পেয়েছি
প্রচুর হাততালি। সাংবাদিক রা ফটাফট ছবি তুলে
নিয়েছিল আমার। পরদিন পত্রিকায় আমার
ছবি সহ লিড নিউজ ও হবার কথা ই ছিল এবং
হয়েছিল ও তাই। আমি একটা বিশেষ হার্ট
সার্জারি আবিষ্কার করেছিলাম- যেটা আজ
পৃথিবীর সব দেশে দেশে
রোগীদের জীবন বাঁচাচ্ছে-
মানুষকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে নতুন
জীবনের।সেমিনারের সফলতা তাই
জুড়ে ছিল আমার মনে প্রানে। রাস্তায়
যেতে যেতে সেদিন আমি গান
শুনছিলাম। গানের তালে তালে ধীর
গতিতে গাড়ি চালাই আমি। বেশি গতি আমি
কখনোই তুলিনা।সেদিন ও ৫০ এর
কাছাকাছি গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। সিলেট
থেকে রওনা দিয়ে উজানভাটি এলাকার
কাছাকাছি আসতেই হটাত করে আমার
সামনে এক সাদা পাঞ্জাবি পড়া বৃদ্ধ লোক
এসে দাঁড়ায়। রাত তখন প্রায় দুইটা। এই
সময় রাস্তায় হাইওয়ের গাড়ি গুলো ছাড়া
কোন যানবাহন ও ছিলনা। হটাত করে
আমার সামনে কোত্থেকে লোকটা
এসে পড়ল কিছু বুঝে ওঠার আগেই।
আমি ও লোকটাকে বাঁচাতে গিয়ে ও
পারলাম না। সোজা সেই লোকের
ঊপর চালাতে বাধ্য হলাম। আর
সেখানেই গাড়ির সামনের অংশে বাড়ি
খেয়ে লোকটা ছিটকে পড়ল হাত
পাঁচেক দূরে। আমি হার্ড ব্রেক কষে
সেইবৃদ্ধের কাছে ছুটে গেলাম।
কিন্তু ততক্ষনে সব শেষ। মাথার কাছটায়
আঘাতে মৃত্যু বরন
আমি কোন দিন এক্সিডেন্ট করিনি।
সেটাই ছিল আমার প্রথম এক্সিডেন্ট।
আমি দিশেহারা হয়ে যাই। কিভাবে কি করব
বুঝে ঊঠতে না পেরে কিছুক্ষন ঝিম
মেরে থাকলাম সেখানেই। তারপর
বৃদ্ধকে গাড়িতে তুললাম। পাশে বসিয়ে
আবার ড্রাইভ করলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে।
ঢাকায় পৌছে সোজা মেডিক্যাল এ নিয়ে
গেলাম লাশ টাকে। সেখানে গিয়েই
পুলিশ কে জানানো হল। পুলিশ এসে
আমার কাছ থেকে জবানবন্ধি নিয়ে লাশ
টা থানায় নিয়ে গেল। আমি প্রথমে ঠিক
করেছিলাম পুলিশ কে সব খুলে বলব।
কিন্তু পরে কি ভেবে যেন আমি
মিথ্যে বলি। পুলিশ ও আমার কথা গুলো
কোন রকম সন্দেহ ছাড়াই বিশ্বাস
করে। নিজের কাছে আমি কিছু টা
অপরাধী বোধ করলে ও নিজের
ইমেজ বাঁচাতে এই মিথ্যেটা আমাকে
বলতেই হয়েছে। তারপর কেটে
গেছে অনেক গুলো মাস। আমি আমার
আবিষ্কৃত প্যারা সার্জারি সিস্টেম এর জন্য
অনেক গুলো পুরষ্কার ও পাই। খ্যাতি
আর অর্থ দুটোই এসে ধরা দেয়
আমাকে। ধীরে ধীরে নিজের
উপর আত্মবিশ্বাস বেড়ে চলে আমার।
নিজেকে কিছুটা ঈশ্বরের
সমপর্যায়ের ভাবতে থাকি। এরজন্য মিডিয়া
ও কম দায়ী নয়।খবরের পাতায় কারো না
কারো জীবন বাঁচানোর জন্য আমি
ঊঠে আসতে থাকি নিয়মিত ভাবে।
ধীরে ধীরে আমি অনেক অনেক
বেশী অহংকারী হয়ে ঊঠি। কাউকেই
পরোয়া না করার একটা ভাব চলে আসে
আমার মাঝে। মানুষ কে আমি মনে
করতে শুরু করি হাতের পুতুল। আমি
চাইলেই যেকোন মৃত্যু পথযাত্রীর
জীবন বাচিয়ে দিতে পারতাম। এই জন্য
আমার কাছেই ছুটে আসতে লাগল
হাজারো মানুষ। এই যশ আর খ্যাতি যখন
তুঙ্গে তখন আমার
কাছেই রুগী হয়ে আসেন
বাংলাদেশের প্রথিত যশা রাজনীতিবিদ
রেজোয়ানুল হক। আমি বাকি সবার মত
উনাকেও আস্বস্থ করেছিলাম যে উনার
কিছু ই হবেনা। যেদিন উনার অপারেশন –
সেদিন আমি আরো দুটি হার্ট অপারেশন
করে ফেলেছিলাম। তাই কিছু টা ক্লান্তি
ছিল। একটানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপারেশন
গুলো করতে হয়। তাই ক্লান্তি ভর
করে সহজেই। আমি ক্লান্ত থাকলে ও
মনে মনে পুলকিত ছিলাম কারন এর
পরেই আমি রেজোয়ানুল হকের
অপারেশন করবো। উনাকে যখন
অজ্ঞান করা হল তখন আমি নিজের
কস্টিউম পড়ছি। জুনিয়র ডাক্তার কে
দিয়েই এগুলো করাই আমি। আমি শুধু
গিয়ে কাটাকাটির কাজ টা করি। সেদিন ও
জুনিয়র তিনজন ডাক্তার মিলে সব
প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা সেরে
আমাকে কল দিল। আমি ও গেলাম। আর
গিয়েই শুরু করলাম অপারেশন। ওপেন
হার্ট সার্জারি ছিল সেটা। আমি যখন সব
কেটে কুটে মাত্র হার্ট টাকে
দেখতে লাগলাম এমন সময় আমার
চোখ গেল ওটি রুমের বাম কোনায়।
সেখানে আমার দিকে তাকিয়ে বসে
আছে সেই বৃদ্ধ। আমি দেখে
চোখের পলক ফেলতেই দেখি উনি
নেই। হ্যালুসিনেশন মনে করে আবার
অপারেশন শুরু করলাম। রেজোয়ানুল
হকের হার্ট এর নিলয় এর দুটো শিরায়
চর্বি জমেছিল। আমি সেগুলো পরিষ্কার
করতে করতে হটাত করে কানের
কাছে একটা কাশির শব্দ শুনলাম। প্রথমে
পাত্তা দিলাম না। কারন এইখানে কোন ভুল
হলেই রোগী মারা যাবেন। আমার
কোন রকম ভুলের কারনে এতবড়
মানুষ টার মৃত্যু হবে ভেবে আমি আবার
মনযোগ দিলাম। কিন্তু আবার কাশির শব্দ
আসল। কাশিটা আসছিল বাম দিক থেকে।
আমি বামে মাথা ঘুরিয়ে দেখি বৃদ্ধ হাসি হাসি
মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঠোট
নাড়ার আগেই বলে ঊঠল – “বাবাজি তুমি
তো উনাকে বাঁচাতে পারবানা” আমি অবাক
হয়ে গেলাম। আমি আকাশ পাতাল চিন্তা
করে চলেছি। একজন মৃত মানুষ কিভাবে
আমার পাশে এসে দাড়াতে পারে
সেটাই মাথায় আসছিল না। আমি কোন
উত্তর দেবার আগেই সেই লোকটি
বলল- “ কি বুঝতে পারছো নাতো?
শোনো- আমি জানি তুমি অনেক চেষ্টা
করবে উনাকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু
পারবেনা”- বলেই আবার হেসে দিল সাদা
পাঞ্জাবি পড়া বৃদ্ধ। আমি বিহ্বল হয়ে
তাকিয়ে আছি উনার দিকে। কি বলব
বুঝতে পারছিনা। উনাকে কি বলবো
বুঝতে বুঝতে কাটিয়ে দিলাম পাঁচ
সেকেন্ড। তারপর আবার মনযোগ
দিলাম অপারেশনে। রোগীর
অপারেশন সাকসেস হল। আমি ও হাপ
ছেড়ে বাঁচলাম। সেলাই করে দিয়ে
শেষ বার ড্রেস করতে দিয়ে আমি
মাস্ক খুলতে যাব এমন সময় হটাত করে
রোগীর পালস রেট গেল বেড়ে।
মেশিন গুলো যেন চিৎকার শুরু করে
দিয়েছে। হটাত করে বুকের ভেতর
ধপধপ করা শুরু করল। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে
রোগীর প্রেশার দেখলাম-
বেড়েই চলেছে প্রেশার। হটাত
করে এই অবস্থা হবার কথা না। আমি
কয়েকজন ডাক্তারকে বললাম
প্রেশারের ইনজেকশন দিতে। ওরা
সেটা দিতেই প্রেশার ডাউন হওয়া শুরু
করল। কিন্তু আবার ও বিপত্তি। এবার
প্রেশার
কমতে লাগল। আমি আবার টেনশনে
পড়ে গেলাম। কিন্তু কোনভাবেই কিছু
করতে পারলাম না। রোগীর হার্ট বিট
ভয়ানক ভাবে কমতে কমতে
একেবারে শুন্য হয়ে গেল নিমিশে।
এবং আমি তাকিয়ে তাকিয়ে রেজোয়ানুল
হকের মরে যাওয়া দেখলাম। প্রথম বার
আমার সামনে এক রোগী বলে
কয়ে মরে গেল- আমি কিছুই করতে
পারলাম না। আমি আমার রুমে এসে বসে
পড়লাম। রাগে আমার গা জ্বলতে শুরু
করল। নিজেকে অনেক অসহায় মনে
হতে লাগল। পরদিন বিভিন্ন পত্রিকায়
রেজোয়ানুল হকের পাশাপাশি আমার
হতাশাগ্রস্থ মুখ ও প্রকাশিত হল। মিডিয়া এমন
এক জিনিস- কাঊকে মাথায় তুলতে
দেরী করেনা- কাউকে মাটিতে আছাড়
মারতে ও দেরী করেনা। আমাকে ও
মাটিতে নামিয়ে আনল ওরা। আমার
বিরূদ্ধে হত্যা মামলা রজু করা হল সেই
নেতার দলের লোকজনের পক্ষ
থেকে। কিন্তু সরকার আমার পাশে ছিল
বলে মামলা ধোপে টেকেনি। টাকা
পয়সা খাইয়ে পুলিশ আর আদালতের
সবকটাকে কিনে নিয়েছিলাম। তারপর
আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। আমি ও
ফিরে আসি বাস্তব জীবনে।
রোগীদের সেবায় মনযোগ দেই।
ছোটখাট অপারেশন এ যোগ যেই।
এরপর আসতে আসতে আমার জীবন
স্বাভাবিক হয়ে ঊঠে। কিন্তু এর ঠিক ছয়
মাস পড়েই এই মহিলা ডাক্তার কে
অপারেশনের দায়িত্ব পরে আমার উপর।
আমি নিরুপায় ছিলাম। উনাকে আমি
কর্মজীবনে শ্রদ্ধা করতাম। আমার
শিক্ষিকা ছিলেন। উনার হার্টে ব্লক ধরা
পড়াতে উনাকে অপারেশনের দায়িত্ব
উনি নিজেই আমাকে দেন। খুব ছোট
অপারেশন। হরহামেশাই এই ধরনের
অপারেশন হত-এখন ও হয়। হার্টের যে
ধমনী গুলো ব্লক হয়ে যায়
সেগুলোতে রিং পড়ানোর কাজ। আমি
প্রথমে রাজি হইনি। কিন্তু রোগীর
পীড়াপীড়ি তে রাজি হই।
অপারেশন টেবিলের সামনে এসেই
আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। কারন
সেখানে সেই দিনের মতই বাম
কোনায় বসে ছিল সেই বৃদ্ধ। উনাকে
দেখেই বুকের ভেতর কেমন যেন
করে উঠে আমার। অজানা আশংকায়
কেঁপে উঠে মন। কিন্তু বাধ্য হয়ে
আমাকে অপারেশন করতে হয়। আমি ও
শুরু করি। হার্টের ধমনী একটাতে রিং
পড়ানো শেষ করে আরেকটা যখন
ধরবো এমন সময় কানের কাছে
ফিসফিস করে বৃদ্ধ সেই আগের মতই
বলল- “বাবাজি- আজকা ও তুমি উনারে বাচাতি
পারবানা” হাসি হাসি মুখের ভেতর যেন
রাজ্যের ঘৃণা। আমি উনার চেহারার দিকে
এক পলক তাকিয়েই আবার কাজ শুরু
করলাম। কিন্তু রিং পড়াতে গিয়েই হটাত
করে ভুল করে কেটে গেল ধমনী
টা। গলগল করে রক্ত বের হতে শুরু
করল। নিরুপায় হয়ে তিন চার জন মিলে
সেই রক্ত বন্ধ করে ধমনী পরিষ্কার
করে জোড়া লাগাতে বসল। আমি
নিজেও হাত দিলাম। কিন্তু যা হবার তাই হল।
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে রোগীর
অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেল। আমি
রক্তের জন্য লোক পাঠালাম। কিন্তু
সামান্য ও পজেটিভ রক্ত সেখানে
ছিলনা। এতবড় একটা হাসপাতালে ও
পজেটিভ রক্ত না পেয়ে সেই ডাক্তার
আপা মারা গেলেন চোখের সামনে।
আমার কিছু ই করার ছিলনা। এরপর একদম
ভেঙ্গে পড়েছিলাম আমি। আমার পরিবার
থেকে বিয়ে করার জন্য চাপ আসল।
আমি ও বিয়ে করলাম। মিতি- আমার বৌ-
লক্ষ্মী বৌ আমার। যাকে বলে
একেবারেই আটপৌরে মেয়ে। বিয়ে
হয়েছে আমাদের মাত্র তিন সপ্তাহ।
এরমাঝেই আমাকে করেছে আপন।
কিন্তু ভাগ্য সহায় না থাকলে যা হয়- বিয়ের
তিন সপ্তাহের মাথায় ওর আব্দার রাখতে
গেলাম কক্সবাজার এ। সেখানে প্রথম
দিনেই একটা আছাড় খেল মিতি বাথরুমে।
প্রথমে আমি তেমন কিছু না বলে পাত্তা
না দিলে ও পরে বুঝতে পারি মিতির
কোন একটা বিশেষ সমস্যা হয়েছে।
তখনই আমি মিতিকে নিয়ে আসি ঢাকায়।
পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানতে পারি
মিতির মাথায় রক্তক্ষরণ হয়েছে
আছাড়ের ফলে। খুব দ্রুত মিতিকে
অপারেশন করাতে হবে। নিজের
স্ত্রী বলে মিতির অপারেশন আমি
করতে চাইনি। কিন্তু সেই মুহূর্তে সব
ভাল ভাল সার্জন রা দেশের বাইরে
থাকাতে আমাকেই দায়িত্ব নিতে হল।
আমি ও মেনে নিলাম অর্পিত দায়িত্ব। আমি
এখন বসে আছি মিতির রুমের সামনে।
আরেকটু পর মিতির অপারেশন। আমি
মিতির দিকেই তাকিয়ে ছিলাম- কিন্তু হটাত
করে চোখ গেল মিলির কেবিনের
বাম কোনায়। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে
সেই বৃদ্ধ। জানিনা কি হবে আজকে।
যে কোন ভাবে মিতিকে বাঁচাতেই
হবে। কিন্তু আজরাইলের বেশে
বৃদ্ধের মুচকি হাসি দেখে আমার আশার
প্রদিপ নিভতে শুরু করে দিয়েছে…
Hasan